ইসলাম ধর্ম ও নারীঃ ঘর-সাংসা্রের কাজ নারীর জন্য অবমাননাকর ? না্রীর বন্দীত্ব? -আইনুল বারী
১১৫.ইসলাম ধর্ম ও নারীঃ
ঘর-সাংসা্রের কাজ নারীর জন্য অবমাননাকর ? না্রীর বন্দীত্ব?
-আইনুল বারী
-- ------ ----------------------------------- --------------------------
আধুনিক যুগে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাম্রাজ্যবাদ আজো সভ্যতার এক অভিশাপ। একে বাঁচিয়ে রাখতে ও সম্প্রাসারিত করতে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে মহা- প্রবঞ্চনাময় ভোগবাদী জীবনদর্শন। পুঁজির (লোভের) দানব অধিপতিদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিবাণের জন্যে পূর্বের যে কোনো সময়ের চেয়ে কৌশলী অস্ত্র হলো এ ভয়ংকর ভোগবাদ ! গুটি কয়েক কর্পোরেট দানব পুঁজিপতির শোষণের বস্তু এখন পুরো মানব সমাজ। তারই একটি টার্গেট ইসলাম ধর্ম, মুসলমান সমাজের পুরুষ ও নারীরাও। বিরাট সংখ্যক মুসলিম পুরুষ ও নারীরা এখনো নগ্নতার সংস্কৃতি মেনে নেয় নি, ফ্যাশান,স্টাইল ও সৌন্দর্য-প্রাসাধনী পণ্যের উপযুক্ত ভোক্তা হয়ে ওঠেনি বলেই তারা টার্গেট। যে কারণে মুসলিম পরিবারগুলির গৃহস্থালী দায়িত্ব পালনে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে তুচ্ছ করতে লেবেলিং করা হচ্ছেঃ 'রক্ষণশীল', 'বন্দীত্ব', 'অনগ্রসর', 'স্বল্প শিক্ষিত', 'বৈষম্যপূর্ণ-নির্যাতিত', 'বর্বর', ইত্যাদি নামে। প্রচারণার মিমগুলি (meme) হলো, ইসলাম ধর্ম নারী বিদ্বেষী, পুরুষতান্ত্রিক, মুসলমান নারীদেরকে ঘরে বন্দী করে রাখতে চায়, পর্দার নামে তাদের চলাফেরা সীমিত করে রাখতে চায়, স্বল্প শিক্ষিত রেখে অধিকারবঞ্চিত করে, অন্দরমহলে আটকে রেখে সন্তান-লালন-পালনের কাজে সারা জীবনে স্বামীর সেবাদাসী হিসেবে খাটাতে চায়। ঘর-সংসারের কাজ নারীর জন্য অবমাননাকর, এটি কোনো পেশা নয়, নারীকে ছোট করা, নারী সত্ত্বার স্বাধীনতাকে খর্ব করা, তার মুক্ত বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করা।
(২) সংকীর্ণ মোল্লাতন্ত্র যেভাবে কুর'আনের শিক্ষাকে পরিত্যাগ করে মুসলমান সমাজকে ক্ষতবিক্ষত করেছে কুসংস্কার ও বিচারবিযুক্তবাদের চাবুকে, তেমনি তাদেরকেই পুঁজি করে ভোগবাদী থিংক-ট্যাংক গুলি ব্যস্ত মুসলমান নারীকে, পুরুষকে, স্বামীকে, বাবাকে,পুত্রসন্তানকে, ভাইকে চিত্রিত করেছে বর্বর,অ-মানুষ হিসেবে। আর নারীর ঘর-সংসার থেকে বিদ্রোহে করে বেরিয়ে যাওয়াকে, অর্ধ-নগ্ন হয়ে সিনে মগ্যাজিনের মডেল হওয়াকে, সৌন্দর্য প্রতিযোগীতায় জয়ী হওয়াকে, বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করে 'লিভ টুগেদার' করাকে, বিবাহবহির্ভুত স্বাধীন যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাকেও চিত্রিত করা হচ্ছে নারীমুক্তির প্রকাশ হিসেবে। বলা হচ্ছে পুরুষ যা করে, নারীরও তা করতে পারে, তা করার অধিকার তাদের আছে; অর্থাৎ বলা হচ্ছে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা।
(৩) কিন্তু ইসলাম ধর্ম কুর'আনের শিক্ষায় পরিষ্কারভাবে উম্মোচিত করেছে, ভোগবাদী জীবন দর্শন ও নারী মুক্তির তথাকথিত আধুনিক ধারণাটি একটি ভুল দৃষ্টিভঙ্গি ও মানুষে জন্যে অশুভ। ইসলাম ধর্ম নারী-পুরুষের সমান (equal) অধিকার নয়, সমতাভিত্তিক (equity) অধিকারের দিক-নির্দেশনা দেয়।
ইসলাম ধর্ম আরও শেখায়, স্ত্রী হিসেবে নারীর ঘর-সংসার তৈরির কাজ অবমাননাকরতো নয়ই, বরং তার বিপরীত, তা অনেক সম্মানের, অনেক মর্যাদার কাজ, কোনোভাবেই নারীর বন্দীত্ব নয়।
স্ত্রীর প্রধান দায়িত্ব সংসারকে ভেতর থেকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করা। মায়ের দায়িত্ব সন্তানকে মাতৃত্বের মমতায় স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করা। এ ভূমিকা নিয়ামক, কেননা সংসার তথা পরিবার সমাজের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংগঠন, সমাজকে যদি দেহ ভাবা হয়, প্রতিটি সংসার-পরিবার হচ্ছে এক একটি কোষের প্রটোপ্লাজমের মতো। সভ্যতার রচনায় পরিবার মূল প্রেরণা।
অন্য দিকে, স্বামীর প্রধান দায়িত্ব সংসারের ঘর-সংগঠনের বাইরের কাজগুলি সুসম্পন্ন করা। বাইরের কাজগুলিও গুরুত্বপূর্ণ, বাইরের প্রতিকূলতা থেকে সংসারকে নিরাপদ রাখতে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হয় স্বামীকে। পরিবারের অর্থনৈতিক বিষয়গুলি ও সামাজিক যোগাযোগগুলি পুরুষের পক্ষে যতোটা স্বচ্ছন্দ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব, ততোটা কি নারীর পক্ষে সম্ভব? বাস্তবতার কারণেই তা সম্ভব নয়। তবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে স্বামীর পক্ষে তার দায়িত্ব পালন করা সম্ভব না হলে স্ত্রী যে তা করতে পারবে না, তা কিন্তু নয়, কুর'আনের নির্দেশিত জীবন বিধান কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করেনি। অথবা স্ত্রীর প্রতিভা বিকাশের পথে বাধা নয় ইসলাম। সংসার তার বন্দীত্ব নয়, সংসারের নিউক্লিয়াস স্ত্রী, প্রোটন, স্বামী ইলেক্ট্রন, এটিই তাৎপর্যপূর্ণ। স্বামী-স্ত্রী একই পারিবারিক বন্ধন, সংসার তাদের একে অন্যের পরিপূরক হয়ে যৌথ ভূমিকায় টিকে থাকে।
(৪) ভোগবাদী জীবন দর্শন মানুষকে নিজের সত্তা থেকে ক্রমাগত বিচ্ছন্ন করতে করতে আজ যেনো চিন্তাহীন বিবশ প্রাণীতে(mindless creatures) পরিণত করেছে।এ বিচ্ছিন্নতা শুধু তার অর্থনীতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয়, এ তার নিজস্ব বোধ-সত্তা থেকেও, সে নিজস্ব মূল্যাবোধ ও মূল্যায়ন থেকে নিজেকেই বিচ্ছিন্ন হতে দেখে। যা তার কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত, তাকেই তার কাছে কাংক্ষিত পণ্যে পরিণত হতে দেখে। এ ভাবে ভোগের বাজার গ্রাস করে যাচ্ছে সবকিছু, প্রায় সব কিছুকেই পণ্যের পরিণত করে অনন্ত ক্ষুধাময় বাজারকে সম্প্রসারিত করে চলেছে । ভোগাবাদের গবেষণা কাজে নিয়োজিত চৌকষ কারখানাগুলি রুচি, ফ্যশান, মূল্যবোধ তৈরি করে বিধি, বিজ্ঞাপণ ও প্রচারণা ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আদর্শায়ন করে সমাজের টাইম-লাইনে ক্ষণে ক্ষণে উপস্থাপন করছে।
তাই ভোগবাদী জীবন-দর্শনে নারীর ঘর-সংসারের চেয়ে অনেক বেশি সম্মানের পেশা হচ্ছে আয়-উপার্জনের চাকুরীজীবীর পেশা। সঙ্গত কারণে মুসলমান নারীর বন্দীত্ব সৃষ্টিতে গুরুত্ব ভূমিকা রাখাই হচ্ছে কর্পোরেট সিন্ডকেটগুলির ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির লুকায়িত এজেন্ডা। এর বিপরীতে ইসলাম নারীকে যথাযথ সম্মান দিয়েছে, মুক্তি দিয়েছে ভোগবাদী বাজারব্যবস্থার পণ্যে পরিণত হওয়ার হাত থেকে।
(পুরোনো লেখা, সম্পাদিত।)
Comments
Post a Comment