অপব্যাখ্যাত আয়াত ৪ঃ৩৪- স্ত্রীকে প্রহার করা কি ইসলামে অনুমোদিত?-আইনুল বারী
১১১.অপব্যাখ্যাত আয়াত ৪ঃ৩৪- স্ত্রীকে প্রহার করা কি ইসলামে অনুমোদিত?
-আইনুল বারী
-----------------------------------------------------------------------------
অপব্যাখ্যাত আয়াত ৪ঃ৩৪- স্ত্রীকে প্রহার করা কি ইসলামে অনুমোদিত?
-----------------------------------------------------------------------------
(১) ৪ঃ৩৪ আয়াতটির যে ধরনের বাংলা অনুবাদ সচরাচর করা হয়, তা হলোঃ
‘পুরুষেরা নারীদের উপর দায়িত্বশীল (কাওয়াম)। এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে বিশ্বাসী স্ত্রীগণ হয় অনুগত ও আল্লাহ যা সংরক্ষণযোগ্য করেছেন লোকচোখের অন্তরালেও তার সংরক্ষণ করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা করো তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ করো এবং প্রহার করো (?) (ইদ্রিবুহুন্না-ক্রিয়াপদ ‘দা-রা-বা’)। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোনো পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।’-সূরাহ নিসা(অধ্যায়-৪),আয়াত-৩৪
আয়াতটির অপব্যাখ্যা মূলতঃ 'দা-রা-বা' শব্দটিকে ঘিরে ও কয়েকটি হাদিসের উদাহরণ টেনে। দা-রা-বা অর্থ করা হয় 'প্রহার করা', যদিও এর ভিন্ন কিছু অর্থ আছে, এবং এই আয়াতে যোগ্য অর্থ হওয়া উচিত 'আলাদা থাকা' । 'প্রহার করা' এর অর্থের পেছনে পুরুষ তান্ত্রিকতার মনস্তত্ত্ব যেমন আছে, তেমনি ঐতিহাসিক বাস্তবতার যোগ-বিয়োগও ঘটেছে। কেননা দাম্পত্য কলহের এক পর্যায়ে স্ত্রীকে কোন বিবেচনায় প্রহার করতে হবে, তা মোটেও বোধগম্য নয়। না যুক্তিতে, না নৈতিকতায়।
(২) ৪ঃ৩৪ আয়াতে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদের মতো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে থেকে বাঁচাতে কয়েকটি ধাপে স্ত্রীকে কীভাবে শুধরে নিতে বা সেজন্যে তাকে সাহায্য করতে দিক-নির্দেশনা রয়েছে,
প্রথমতঃ সদুপদেশ দান, অর্থাৎ কথা বলে বোঝানো। এটি কতোদিন চলবে তার উল্লেখ নেই, তবে যতোদিন দাম্পত্য কলহ মেটানোর মতো আশা আছে, ততোদিন স্বামী স্ত্রীকে সংসার ফেরাতে সুন্দরভাবে বোঝাবে। সমস্যা মিটে গেলে উভয়ের জন্যে ভালো, কিন্তু যদি বোঝানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়, তখন দ্বিতীয় ধাপের চেষ্টায় যেতে হবে। এ ধরণের হিতোপদেশ কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না, যদি স্বামী নিজেই ভালো না হয়। আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা কি মানুষকে সৎকর্মের নির্দেশ দাও আর নিজেরা তা করতে ভুলে যাও? আর নিজেরা তা করতে ভুলে যাও? অথচ তোমরা কুর’আন পাঠ করো? তবে কি তোমাদের বোধজ্ঞান নেই?’-২:৪৪
দ্বিতীয়তঃ স্ত্রীর অনৈতিক/উচ্ছৃংখল আচরণের প্রতি অসন্তষ্টির প্রকাশ হিসেবে স্বামী তার সাথে একই শয্যাত্যাগ করবে। শয্যাত্যাগের মাধ্যমে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর অনুরাগ ও অভিযোগ প্রকাশ পায়। স্ত্রী যদি বৈবাহিক সম্পর্কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে তবে এটি তার মনে গভীর রেখাপাত করার কথা। দাম্পত্য কলহ মিটে গেলে, স্ত্রী নিজেকে শুধরে নিলে, তারা এক শয্যায় ফিরে যাবে। কিন্তু স্ত্রী যদি নৈতিক স্খলন থেকে নিজেকে শুধরে না নেয়, বা রাজী না হয়, তখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে স্ত্রী যথাযথ গুরুত্ব দিতে চায় না, বা যথেষ্ট দায়িত্বশীল নয়। তবুও ধৈর্য ধারণ করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টার সুযোগ রয়েছে, তৃতীর ধাপে ।
তৃতীয়তঃ চূড়ান্ত বিচ্ছেদ এড়াতে আরও কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কিন্তু এক শয্যাত্যাগের চেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা কী হতে পারে? পরষ্পর আলাদা হয়ে যাওয়া, স্বামী-স্ত্রীর কিছু দিনের জন্যে আলাদা বসবাস। এই অস্থায়ী বিচ্ছেদ স্বামী ও স্ত্রী উভয়কেই স্বাধীন মতো ভাবনা-চিন্তার ও নিজেকে শুধরে নেয়ার অবকাশ দেয়। সংসার টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করতে বাধ্য করে। এখানেই দা-রা-বা শব্দটি এসেছে, যার একটি অর্থ ‘আলাদা হয়ে যাওয়া’, যা আলাদা বসবাসের অর্থে অনুবাদ করা যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রভাবশালী মোল্লাতন্ত্র দা-রা-বা শব্দের অর্থ করেছ ‘প্রহার করা’, তাই স্ত্রী সাথে শয্যাত্যাগে ফল না হলে তাকে প্রহার করার পক্ষে অনেকে্র মত । তবে প্রহারের আগে যোগ করা হয়েছে হালকা, এ হলো হালকা ধরণের প্রহার, একটি মেশওয়াক(টুথব্রাশ)দিয়ে বাড়ি মারার মতো করে, যাতে শরীরে আঘাতজনিত কোনো ক্ষত তৈরি না হয়। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, স্ত্রীকে শারীরিকভাবে প্রহার করে সংশোধনের চেষ্টা করা, এ কেমন যুক্তি? এ যুক্তি, ন্যায়বিচার, মূল্যবোধ, কোনো কিছুর সাথেই মেলে না। এও কি সম্ভব মেশওয়াকের হালকা প্রহারে স্ত্রীর হুঁশ ফিরবে, যখন তাকে এতো বুঝিয়ে, শয্যাত্যাগ করেও কিছু হলো না! অথবা, বিদ্রোহী মনে ভীতি সৃষ্টি করে আত্মোপলব্ধি অর্জন করা যায় কি? হয়তো মেনে নিতে বাধ্য করা যায়, কিন্তু আত্মশুদ্ধি আত্মোপলব্ধির অনুপ্রেরণা ছাড়া পূর্ণতা পায় না, তা ছাড়া স্বামীকে যদি একইভাবে শুধরে নিতে হয়, তখন স্ত্রী কী করবে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কি তা মেনে নিবে? আল্লাহ নিশ্চয় নারী ও পুরুষ সকলের প্রতি ন্যায়বিচারক!
(৩) দুঃখজনক যে এর পক্ষে অনেকে যুক্তি দেখাতে যান যে দাম্পত্য সংকটের এক পর্যায়ে স্ত্রীকে প্রহা্র করা আল্লাহ প্রদত্ত স্বামীর একটি বৈধ অধিকার/ক্ষমতা নয়। । নবী কি তাঁর জীবনে কখনো এমন কোনও আচরণ করেছিলেন? তিনিও স্ত্রীদের কারো কারো আচরণে কষ্ট পেয়েছিলেন, ভীষণ মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, পরিস্থিত এমন হয়েছিলো যে তিনি এক মাসে জন্যে স্ত্রীদের থেকে আলাদাভাবে থাকার প্রতিজ্ঞা(ই’লা) করেছিলেন ও আলাদা থেকেছিলেন। কিন্তু তিনি স্ত্রীদেরকে সংশোধনের জন্যে প্রহারতো করেন নি!
ঘনিষ্ঠ সাহাবীরা যখন জানলেন নবী স্ত্রীদের থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেছেন, তখন তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন ও তখন গুঞ্জন উঠেছিলো তিনি তাঁর স্ত্রীদেরকে হয়তো তালাক দিয়েছেন। এ প্রসংগে কুর’আনে আয়াত নাযিল হয়েছিলো, সূরাহ তাহরিমের ১ থেকে ৫ নং আয়াত পর্যন্ত এর বর্ণনা রয়েছে।
‘আর যখন নবী সংগোপনে তার স্ত্রীদের একজনকে কিছু কথা বলেছিলো, তারপর সে (সেই স্ত্রী) তা অন্যের কাছে প্রকাশ করে দেয়, আর আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন সে (নবী)এর কিছু অংশ বললো, কিছু বললো না; আর যখন সে(নবী) তাকে (সেই স্ত্রীকে)তা জানানো পর সে(স্ত্রী) জানতে চাইলো, ‘কে এ কথা বললো?’ সে(নবী) বললো, ‘আমাকে জানিয়েছেন যিনি সর্বজ্ঞ, সম্যক-অবগত।’-সূরাহ তাহরিম(অধ্যায়-৬৬), আয়াত-৩
‘যদি তোমরা দু’জনে(নবীর দু’জন স্ত্রী) তোমাদের অন্তরের বিচ্যুতির জন্য আল্লাহ’র কাছে অনুশোচনা করো তবে তা ভালো, আর যদি তোমরা তার(নবীর) বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য করো, তবে নিশ্চয় আল্লাহ তার(নবীর) অভিভাবক, আর জিবরাঈল ও সৎকর্মপরায়ণ বিশ্বাসীরা, এ ছাড়া ফেরেশতারাও তাঁর সাহায়ক।’ -সূরাহ তাহরিম(অধ্যায়-৬৬), আয়াত-৪
‘এমনো হতে পারে যদি সে(নবী)তোমাদেরকে পরিত্যাগ(তালাক) করে, তবে তার প্রতিপালক তাকে তোমাদের পরিবর্তে তোমাদের চেয়ে উত্তম স্ত্রী দিবেন- যারা হবে সমর্পিত, বিশ্বাসী, অনুগত-নিবেদিত, অনুশোচনাকারী, প্রার্থনাকারী, সংযমী(রোযাপালনকারী)-তারা পূর্বে বিবাহিত বা অবিবাহিত ।’ -সূরাহ তাহরিম(অধ্যায়-৬৬), আয়াত-৫
কেউ হয়তো একটি হাদিস দেখাবেন নবী একবার তাঁর স্ত্রী আয়েশাকে মনঃক্ষুন্ন হয়ে বুকে ধাক্কা দিয়েছিলেন, এতে আয়েশা ব্যাথা পেয়েছিলেন (মুসলিম হাদিস সংগ্রহ, বই-৪, হাদিস নং-২১২৭ )। নবীরাও মানুষ, ফেরশতাদের মতো অবিচল থাকা তাদের পক্ষেও সম্ভব নয়, তবে তারা যুগের সেরা মানুষ, কিন্তু ৪ঃ৩৪ আয়াতটিতে যে প্রসঙ্গ তা একেবারে ভিন্ন।
স্ত্রীকে হালকা প্রহারের মাধ্যমে শাসনের ব্যাপারে নবীর (তাঁর প্রতি শান্তি) বিদায় হজ্জ্বের ভাষণের উদাহরণ দেয়া হয়ে থাকে। কিন্তু নান সূত্রে প্রাপ্ত ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে বিদায় হজ্জ্বের ভাষণের অনেকগুলি অনুবাদ রয়েছে, সেগুলিতে বিভিন্নতা রয়েছে। নেট ঘাঁটলেই বেরিয়ে আসে সেসব অনুবাদ। ইংরেজি অনুবাদগুলিতে কোথাও হালকা প্রহারের কথা আছে, কোথাও নেই। মোটামুটিভাবে বলা চলে, বিদায়ী হজ্জে নবী উপদেশ ছিলেনে, স্বামীদের যেমন স্ত্রীদের প্রতি অধিকার আছে, তেমনি স্ত্রীদেরও অধিকার আছে স্বামীদের উপর, উপদেশ দিয়েছিলেন স্ত্রীদের সাথে দূর্ব্যবহার না করতে ও কঠোরতার পথ অবলম্বন না করতে, তাদের প্রতি দায়িত্বশীল হতে ও যথাযথভাবে ভরণপোষণ করতে সতীত্ব রক্ষার সচেতন হতে।
এ ছাড়া, স্ত্রীকে প্রহারের পক্ষে সূরাহ সাদের ৪৪ নং আয়াতটিরও উল্লেখ করা হয়,
‘আর তোমার হাতে এক মুঠো তৃণশলা(গাছে ডাল বা তৃণশলা) নাও, আর তা দিয়ে আঘাত করো, আর শপথ ভঙ্গ করো না; নিশ্চয় আমি তাকে ধৈর্যশীল পেয়েছি, কতো না চমৎকার বান্দা সে! নিশ্চয় সে বারবার আমার কাছে (অনুশোচনায়) ফিরে এসেছে!’ -সূরাহ সাদ(অধ্যায়-৩৮,আয়াত-৪৪
ইবনে কাথিরের তাফসির অনুসারে, আইয়ুব নবী তাঁর অসুস্থকালীন সময়ে কোনো কারণে তাঁর স্ত্রির প্রতি মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে শপথ করেছিলেন, সুস্থ হলে স্ত্রীকে বেত্রাঘাত করবেন। তারপর তিনি সুস্থ হলে আল্লাহ’র নির্দেশ আসে তাঁর প্রতি, যেহেতু তিনি শপথ করেছেন, তার দায় মেটাতে। সুস্পষ্টতঃই এ আয়াতের প্রাসঙ্গিকতা ভিন্ন, স্ত্রীকে শাসনের জন্যে প্রহারকে স্বামীর অধিকার করা হয়নি।
(৪) ৪:৩৪ আয়াতের ঐতিহাসিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে মক্কা ও মদিনার পারিবারিক জীবনের তুলনা চলে, মক্কার জীবন যেখানে ছিলো মদিনার তুলনায় মফঃস্বল ধরণের, মদিনায় এক ধরণের কসমোপলিটন ধরণের নগর সংস্কৃতির আবির্ভাব ঘটেছে। মক্কার নারীরা যেখানে ছিলো স্বামীদের প্রতি যথেষ্ট অনুগত, নম্র ও অতিথিপরায়ণ, সেখানে মদিনার নারীরা ছিলো স্বাধীনচেতা, খোলামেলা স্বভাবের ও পার্থিব ভোগবিলাসে আকৃষ্ট। সে কারণে মদিনায় পারিবারিক জীবনে দাম্পত্য কলহের পরিমাণ বেড়ে যায়, স্ত্রীদের বিদ্রোহী স্বভাবের কারণে তাদেরকে শারীরিক প্রহার করা প্রয়োজন, এমন পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং এ মনস্তত্ত্ব যে কোনোভাবে হাদিসের মধ্যেও ঢুকে পড়ে। যেমন একটি অদ্ভুত হাদিস,
‘শেষ বিচারের দিনে স্বামীকে প্রশ্ন করা হবে না কেনো সে তার স্ত্রীকে প্রহার করলো।’ (আবু দাউদ সংগ্রহ, বই-১১, হাদিস নং-২১৪২)
(৫) ৪ঃ৩৪ আয়াতের মর্মার্থ আরও পরিষ্কার হয় এর ধারাবাহিকতায় ৪ঃ৩৫ আয়াতে এসে, আলাদা বসবাস করেও যদি সমস্যার সমাধান না হয়, তাহলে বুঝতে হবে শেষ চেষ্টা হিসেবে তাদের মধ্যস্থতার প্রয়োজন, যে সম্পর্কে পরের আয়াতে উল্লেখ আছে।
‘আর যদি তোমরা দু’জনের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মতো পরিস্থিতির আশঙ্কা করো, তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ে সংশোধিত হতে(মীমাংসা)চাইলে আল্লাহ তাদের এক করে দিবেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, অবগত।’-৪:৩৫
তবে এখানে উল্লেখ্য, দাম্পত্য সমস্যা নিরসনে স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সংগত মীমাংসা করে নিতে পারে, যদি কখনো স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে অসাদাচরণ ও উপেক্ষার আশংকা করে। আল্লাহ বলেছেন,
‘আর যদি কোনো নারী তার স্বামীর কাছ থেকে অসদাচারণ কিংবা উপেক্ষার আশংকা করে, সে ক্ষেত্রে তারা যদি নিজেদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ন্যায়সঙ্গত মীমাংসা করে নেয়, তাতে দোষ নেই; এমন মীমাংসাই শ্রেয়তর; কিন্তু মনের ভিতরে লোভ সৃষ্টি হয়ে আছে’ যদি তোমরা ভালো কাজ করো ও ধার্মিক হও; নিশ্চয় তোমরা যা করো আল্লাহ জানেন।’-৪ঃ১২৮
যদি স্বামী-স্ত্রী কেউ তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট দায়িত্বশীলও না হয়, যদি অভিভাবক হিসেবে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্ততাতেও কাজ না হয়, তাহলে বুঝতে হবে তাদের মধ্যে যথেষ্ট ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ নেই, তখন জোর করে সংসার টিকিয়ে রাখার চেয়ে বিচ্ছেদই চূড়ান্ত সমাধান হতে পারে। কিন্তু তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছেদের পরও একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত (দু’বার তালাক পর্যন্ত) আল্লাহ আত্মসংশোধিত হয়ে ফিরে আসার সুযোগ রেখেছেন।
কুর’আনে বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন প্রসঙ্গে স্ত্রীর সাথে স্বামীর ব্যবহার কেমন হবে সে সম্পর্কে বলা আছে, কিন্তু কোথাও স্ত্রীকে শারীরিকভাবে আঘাত করে শাসনের কথা নেই। নেই, কেননা তা বিবেকবোধে যেমন মেলে না, যুক্তিতেও মেলে না। আল্লাহ বলেছেন,
‘হে বিশ্বাসীগণ! জোরপূর্বক নারীদেরকে উত্তরাধিকারে গ্রহণ করা তোমাদের জন্যে বৈধ নয় এবং তাদেরকে আটক রেখো না এ কারণে যে তোমরা তাদেরকে যা প্রদান করেছো তার কিছু অংশ ফেরৎ নিতে পারো, যদি না তারা প্রকাশ্য অশ্লীলতার কাজ করে; এবং তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন করো; এরপর যদি তাদেরকে অপছন্দ করো, তবে হয়ত তোমরা এমন এক জিনিসকে অপছন্দ করছো যাতে আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’ -সূরাহ নিসা(অধ্যায়-৪),আয়াত-১৯
(৬) বিখ্যাত নারীবাদী গবেষক ফাতেমা মার্নিসি (Fatema Mernissi,The Veil and the Male Elite,1991 ), তিনি হাদিস ও কুর'আনের বিশ্লেষণ করে তার গবেষণায় তুলে ধরতে চেয়েছেন, নবীর প্রকৃত শিক্ষাকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে কীভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী বিদ্বেষী হাদিসগুলি সংযোজিত হয়েছিলো ও সেগুলি সাদরে গৃহীত হয়েছিলো। অথচ নবী চেয়েছিলেন কুর'আনের শিক্ষার আলোকে সামাজিক সংস্কারের মাধ্যমে ইসলাম পূর্ব যুগের বন্দীত্বের দশা থেকে নারীকে বের করে আনতে। কিন্তু যুগ-পরিবর্তনের এ বিপ্লবী কাজে তিনি নানা দিক থেকে তীব্র বাধার সম্মুখীন হন। এই বাধা আসে মুসলমান সমাজের ভেতরে ও বাইরে থেকে। সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল পুরুষতান্ত্রিক এলিট ধা্রা কি অন্তকরণে চেয়েছিলো যে সম্পদের উপর পুরুষের একছত্র উত্তরাধিকার নষ্ট হোক, স্ত্রীর আইনগত ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে পুরুষের পারিবারিক ও সামাজিক কর্তৃত্ব দুর্বল হোক, দাসীদেরকে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত করার সুযোগ য়ার না থাকুক, অবাধ যৌন সম্পর্ক ও ইচ্ছেমাফিক স্ত্রী গ্রহণ করা্র অসম্ভব হয়ে পড়ুক ইত্যাদি? তাই, নবীর মৃত্যুর পরে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে থাকে, মদিনার বাইরে জন্ম নেয়া অজস্র হাদিস বিভিন্ন সংকটকালে এলিট গোষ্ঠীগুলির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যপূরণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
(৭) (আমার জ্ঞানে) ৪ঃ৩৪ আয়াতের সঠিক অনুবাদ হলো,
‘পুরুষেরা নারীদের উপর দায়িত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে বিশ্বাসী স্ত্রীগণ হয় অনুগত ও আল্লাহ যা সংরক্ষণযোগ্য করেছেন লোকচোখের অন্তরালেও তার সংরক্ষণ করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা করো তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ করো এবং আলাদা থাকো । যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোনো পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ।’-৪:৩৪
এখন এর সাথে মিলিয়ে দেখি নিচের আয়াতগুলিকে,
‘বস্তুত, আত্ম-সমার্পণকারী(মুসলিম)পুরুষ ও আত্ম-সমার্পণকারী(মুসলিম)নারী, বিশ্বাসী(ইমানদার)পুরুষ ও বিশ্বাসী(ইমানদার)নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্য্যশীল পুরুষ ও ধৈর্য্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী,রোযা পালণকারী পুরুষ ও রোযা পালনকারী নারী, সতীত্ব রক্ষাকারী পুরুষ ও সতীত্ব রক্ষাকারী নারী, অধিক হারে আল্লাহকে স্মরণকারী পুরুষ ও অধিক হারে আল্লাহকে স্মরণকারী নারী; আল্লাহ তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহা পুরুষ্কার।’ -সূরাহ আহযাব,(অধ্যায়-৩৩),আয়াত-৩৫
‘আর তাঁর নিদর্শন হলো এই যে, তিনি তোমাদের জন্য, তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করলেন জীবনসঙ্গী(আযওয়াজান),যেনো তোমরা তাদের মাঝে শান্তি খুঁজে পাও, আর তিনি তোমাদের মাঝে মায়া ও দয়া ব্যাপ্ত করে দিলেন; নিশ্চয় চিন্তাশীলদের(অনুধ্যানকারীদের) জন্য এতে নিদর্শন রয়েছে।’-৩০:২১
‘... নারীদের তেমনই অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর, যেমন পুরুষদের অধিকার রয়েছে তাদের উপর, তবে পুরুষেদের কিছুটা বেশি। ...’- ২:২২৮
‘...নিশ্চয় আল্লাহের কাছে তোমাদের মধ্যে সেই সবচেয়ে সম্মানিত, যে আল্লাহ-সচেতন(ধার্মিক); নিশ্চয় আল্লাহ সব জানেন, সব কিছুর খবর রাখেন।’-সূরাহ হুজুরাত(অধ্যায়-৪৯),আয়াত-১৩
‘দুশ্চরিত্র নারীরা দুশ্চরিত্র পুরষদের জন্যে ও দুশ্চরিত্র পুরুষেরা দুশ্চরিত্র নারীদের জন্যে; আর চরিত্রবান নারীরা চরিত্রবান পুরুষদের জন্যে ও চরিত্রবান পুরুষেরা চরিত্রবান নারীদের জন্যেঃ লোকেদের কোনো অপবাদই তাদেরকে(চরিত্রবানদেরকে)কলঙ্কিত করতে পারে না, তাদের জন্যে আছে ক্ষমা ও জীবন নির্বাহের সম্মানজনক উপকরণ।’ -সূরাহ নূর (অধ্যায়-২৪), আয়াত-২৬
'কিন্তু যারা কৃতকর্মের পর অনুশোচনা করে ও সংশোধিত হয়, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু ।' -সূরাহ নূর (অধ্যায়-২৪), আয়াত-৫
আয়াতগুলি কি সুস্থ সুন্দর দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের অনুপ্রেরণা দায়ক নয়? ইসলাম ধর্মে দাম্পত্য সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার শেষ অব্দি যে চেষ্টার কথা কুর’আনের আয়তে আছে, তা কি কোনোভাবে বিবেক-বোধ ও প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে যায়?
Comments
Post a Comment