'শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।' : আমি মানুষ বনাম আমি মুসলমান-আইনুল বারী
'শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।'
: আমি মানুষ বনাম আমি মুসলমান
-আইনুল বারী
---- -------------
'শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।'
- চতুর্দশ খৃষ্টাব্দের বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাস
যারা মানবতাবাদী ও নাস্তিক, তারা যুক্তি দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে চান, আমরা মানুষ।
আমরা হিন্দু না, খৃস্টান না, মুসলমান না, আমরা মানুষ। সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। অন্যদিকে, ধর্মীয় পরিচয়ে এমন উদারতা নেই, তার বদলে আছে সাম্প্রদায়িকতা, বিভেদের সংকীর্ণতা। যখন কেউ বলে, আমি মুসলমান, আমি খৃস্টান, আমি বৌদ্ধ, আমি শিখ, আমি জৈন, তখন তাকে অন্য সকল সম্প্রদায়ের
মানুষকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে হয় । 'মানুষ' বললে এর ভেতরে সবাই চলে আসে, জটিলতা
থাকে না। অসহায় একজন মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ভাবতে হয় না মানুষটি
ইহুদী, নাকি খৃস্টান, নাকি মুসলমা্ন নাকি নাস্তিক। সে একজন মানুষ, এ পরিচয়ই যথেষ্ট। মানুষ পরিচয়ের
মাঝে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, এসব থাকে না। একেই বলে মানবতা। প্রকৃত মানবতা ধর্মীয়
পরিচয়ে মানুষকে বড় করে তোলে না, বরং মনুষ্যত্বের পরিচয়ে বড় করে তোলে। যুক্তি প্রখর, মানবতার
সংজ্ঞা পরিষ্কার। এটিই স্বাভাবিক যে মানবতার আহবান বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী সকল মানুষের জন্যে। তাহলে কীভাবে একজন মুসলমান তার ধর্মীয় পরিচয়কে তার মানুষ পরিচয়ের সাথে মেলাবে?
(২) কুর'আনের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম শেখায়, আমরা মানুষ। তবে আমাদের মাঝে কিছু মানুষ বিশ্বাসী, আর কিছু মানুষ অবিশ্বাসী। মানুষের মাঝে কেউ সৎ কর্মশীল, কেউ অসৎ কর্মশীল। কেউ সত্যবাদী, কেউ মিথ্যাচার করে। কেউ প্রবঞ্চক, কেউবা নির্ভেজাল। আবার সবাই সবসময় একরকম থাকে না, কেউ ভালো থাকতে চেষ্টা করে, কেউ খারাপ পথেই চলতে থাকে। কিন্তু আমরা সকলে মানুষ । মানবতার আহবান, সত্যের আহবান সকলের জন্যে। একজন ক্ষুধার্ত অসহায় মানুষকে সাহায্যের জন্যে বা রক্ত দিতে প্রয়োজন নেই বিবেচনা করার সে হিন্দু কি না, না সে মুসলমান, নাকি নাস্তিক, না শধুমাত্র মানুষ। 'আমি মুসলমান'- এ হলো আমার ধর্মীয় পরিচয়। আমি মানুষ এ হলো আমার বৃহত্তর প্রজাতি পরিচয়, যা অন্য প্রজাতির প্রাণীদের থেকে আমাকে আলাদা করেছে। 'আমি মুসলমান'- এ কথা বললে এর মানে এই হয় না যে, আমাকে অন্য ধর্মের সকলকে বাদ দিয়ে চিন্তা করতে হবে। যারা এমন শেখান তা্রা গুরুতর ভুল শেখান। যখন মুসলমানদের নামাযের জন্যে মসজিদে সমবেত হতে ডাকা হয়, তখন অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আহ্বান জানানো হয় না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কবি, ব্যবস্থাপক-এসব পরিচয় যেমন বৈষম্য সৃষ্টিকারী নয়, তেমনি কোনো ধর্মীয় পরিচয়ও সৃষ্টিকারী নয়। ইসলাম ধর্ম মানুষের মানুষ পরিচয়কে অশ্রদ্ধা করতে শেখায় নি, বরং ভালোবাসতে শিখিয়েছে। কিন্তু এই মানুষ পরিচয় অহংকারী অকৃতজ্ঞতার পরিচয় নয়, তার প্রতিপালককে ছাড়িয়ে যওয়ার নয়। 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই', এ কথা একজন মুসলমান বিশ্বাস করে না। কেনো করে না? তৃতীয় অনুচ্ছেদে এ প্রসংগে আরও কিছু আলাপ করা যাক।
(৩) 'সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই'। উক্তিটি ছোটবেলা থেকে আমরা অনেকবার শুনেছি ও শ্রদ্ধাভরে এর মর্মার্থ উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছি। এ যেনো বিদ্রোহী চির উন্নত মম শীর, এমন উদ্দীপনা, এক তেজস্বী অনুপ্রেরণা! এ ধরণে মানবতাবাদী উচ্চারণ মনের মধ্যে নাস্তিক্যবাদ জাগিয়ে তোলে। ঈশ্বর নয়, মানুষই সত্য, মানুষই মহান, মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। আসলে এখানে মানুষকেই ঈশ্বর বা ঈশ্বরের সমতূল্য ভাবা হচ্ছে। জগতের সব কিছুকে পদানত করে মানুষ বিদ্রোহী চির উন্নত মম শীর। মানুষের প্রয়োজনের কাছে অন্য সবাই সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যাক, কম প্রয়োজনীয় হয়েই থাকুক, অথবা নাকচ হয়ে যাক। কিন্তু না, একজন মুসলমান, একজন বিশ্বাসী এটি মনে করেন না। মানুষের শীর চির উন্নত, তবে আপন স্রষ্টার সামনে নত। আপন প্রতিপালকের কাছে মানুষ আত্মসমর্পিত। মানুষ উদ্ধত-অহংকারী-অকৃতজ্ঞ নয়। মানুষ যাবতীয় অন্যায়-অশুভ শক্তির কাছে শির নত করবে না, কারো আরাধোনা করবে না। কেবল এক পবিত্র মহান সত্তার কাছে ব্যতীত, এটিই তাওহীদের(একত্ববাদের) শিক্ষা। এটিই ধর্মের প্রাণশক্তি।
Comments
Post a Comment