মোল্লাতন্ত্র বনাম ইসলাম -১-মোল্লাতন্ত্রের টাবু থেকে বেরিয়ে আসতে হবে-১ -আইনুল বারী

১১০.মোল্লাতন্ত্র বনাম ইসলাম -১-মোল্লাতন্ত্রের টাবু থেকে বেরিয়ে আসতে হবে
-আইনুল বারী
--------------------------------------

(১) আরবভূমিতে কুর'আন অবতীর্ণ হয়েছিলো মাতৃভাষায়, সেখানকার মানুষ ইসলামকে বুঝতে পেরেছিলো সহজ মাতৃভাষায়। তাদের মাতৃভাষা ছিলো আরবী, তাই আরবীতে কুর'আন তেলাওয়াত তাদের কাছে শুধু আবৃত্তি বা উচ্চারণ ছিলো না, তারা যা কিছু উচ্চারণ করতো মাতৃভাষায়, যা কিছু উপলব্ধি করতো মাতৃভাষায়, সহজাত চিন্তাশক্তিতে। মাতৃভাষায় কুর'আন ও কুর'আনের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার হিসেবে নবীও ছিলেন তাদের সাথে । তাই ইসলাম তাদের কাছে না-বুঝা অন্ধত্বের অনুশাসন বা দৈব তন্ত্র-মন্ত্র ছিলো না, বরং জীবন-যাপনের সহায়ক দিক-নির্দেশনা ছিলো।
তারা যখন একে অন্যের প্রতি উচ্চারণ করতেন,
'সালাম' তারমানে তারা বলতেন, 'শান্তি'
যখন বলতেন, 'আস সালামু আলাইকুম' (আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, আপনার অন্তরে শান্তি আসুক ),
'ইন শা'আল্লাহ' (আল্লাহ যদি চান),
'মাশা'আল্লাহ' (আল্লাহ যেমন চেয়েছেন)
'সুবহানাল্লাহ' (আল্লাহ পবিত্র)
'আল হামদুলিল্লাহ' (প্রশংসা আল্লাহর)
'আসতাগফিরুল্লাহ' (আল্লাহ'র কাছে ক্ষমা চাই)
'নাউজুবিল্লাহ' (আল্লাহ'র কাছে আশ্রয় চাই)
'ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রা-জিউন' (নিশ্চয় আমরা আল্লহ'র জন্য, আর আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাবো)
'লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ' (আল্লাহর ক্ষমতা ও সাহায্য ছাড়া আর কোনো আশ্রয় ও সাহায্য নাই)
'আল্লাহু আকবর' (আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ মহান)

সালাতে দাঁড়িয়ে সুরাহ পাঠ, দোয়া-দরুদ ও রুকু-সেজদাহ থেকে যদি কথার অর্থ মুছে যায়, তবে উচ্চারণ ও সালাতের উঠা-বসা কেবল নিরেট এক যান্ত্রিকতায় পরিণত হয়, এই যান্ত্রিকতা উপলব্ধিবিহীন ধর্মের রিচুয়াল অবশেষ ছাড়া কিছু নয়। মোল্লাতন্ত্র ধর্মের যান্ত্রিক অবয়ব তৈরি করে ও তা নিয়ে অবিরত বাহাসে্ লিপ্ত, হাত বুকের উপর থাকবে না পেটের উপর থাকবে, আমীন জোরে বলতে হবে না আস্তে, মাথায় টুপি নাকি পাগড়ি ইত্যাদি...

তারা বুঝতেন কী বলছেন, এ সব সুন্দর উচ্চারণ, অভিবাদন, প্রার্থণা ছিলো উত্তম নৈতিকতায় সমৃদ্ধ সুন্দর জীবন চর্চারই প্রতিফলন। কিন্তু আমরা কতোজন এ কথাগুলির অর্থ বুঝি ও মনে-প্রাণে মেনে চলি? আমরা যদি না বুঝি তাহলে কেনো বলি? আমরা না বুঝে অসাধারণ কথাগুলি শুধু উচ্চারণ করি আবেগহীনভাবে, না বুঝা অর্থহীন উচ্চারণ সত্যিকার অর্থে ধর্মের কোনও তাৎপর্য বহন করে না। না বোঝা ও অন্তরে ধারণ করতে না পারার কারণে এ সব উচ্চারণ বিকৃত হয়ে যায়, ব্যঙ্গ -বিদ্রূপে পরিণত হয়, আর তন্ত্র-মন্ত্রের উচ্চারনে পরিণত হয়।

(২) নবীর মৃত্যুর পর কুর'আনের ব্যাখ্যাকারের শূন্যতা যেমন সৃষ্টি হলো, আর ইসলাম ধর্ম আরবী ভাষাভাষী মক্কা-মদিনা অঞ্চলের বাইরের জনগোষ্ঠীর মাঝে দ্রুত বিস্তৃতির কারণে সেসব অঞ্চলের ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী মুসলমানদের কাছে মাতৃভাষায় কুর'আনকে তথা ইসলামকে বোঝার ও সঠিক জীবনচর্চার আর আগের মতো রইলো না। তারপর যুগে যুগে নানা ব্যখ্যা, নানা মতভেদ ও স্থানীয় আচার-অনুষ্ঠান-প্রথা মিশে বিভিন্ন ঘরণার মোল্লাতন্ত্রের সৃষ্টি হলো। ইসলাম ধর্মের সর্বজনীন মানবতাবাদের বিপরীতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংকীর্ণ মোল্লাতন্ত্রের বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আধিপত্য মুসলমান সমাজের ঐক্যকে বিনষ্ট করলো ও মানব জাতির ঐক্যের সম্ভাবনাকে সুদূরপরাহত করলো। মোল্লাতন্ত্রের সাথে রাজনৈতিক অভিলাষ মিশে হলো তা পরাক্রম। নবীর মৃত্যুর পর চারজন খলিফার মধ্যে তিনজন খলিফাই অন্তর্দ্বন্দ্বে নিহত হলেন এই মোল্লাতান্ত্রিক রাজনৈতিক মত পার্থক্যের কারণে। সুফি-সাধক, মুসলমান দার্শনিকেরাও লাঞ্ছিত,নির্যাতিত,নিহত হয়েছে।

মানবতার ধর্ম ইসলাম তার উদারনৈতিকতা হারিয়ে শুধু কঠোর বিধি-নিষেধের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীতেই পরিণত হয়নি, ধর্মের বুদ্ধিবৃত্তি ও নৈতিকতার ভিত্তিও দূর্বল হয়েছে। চিন্তাশক্তি, অনুভব শক্তি, কাজের প্রেরণা, জীবন সংগ্রামে আত্মনিয়োগের তাগিদবোধ, একে একে সব দূর্বল হয়ে পড়েছে। ইসলাম ধর্ম বিভ্রান্তির তান্ত্রিকতায় পরিণত হয়েছে। এই তান্ত্রিকতা সৃষ্টি করেছে বিধি-নিষেধের ঘেরাটোপ টাবু (tabu/taboo)। তান্ত্রিকতার মায়াজাল যতোদিন মুসলমান সমাজকে বন্দী করে রাখবে আমরা ততোদিন ইসলামের প্রকৃত রূপ কী তা জানবো না। আমাদেরকে একদিন মোল্লাতন্ত্রের টাবু থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

Comments

Popular posts from this blog

'শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।' : আমি মানুষ বনাম আমি মুসলমান-আইনুল বারী

অপব্যাখ্যাত আয়াত ৪ঃ৩৪- স্ত্রীকে প্রহার করা কি ইসলামে অনুমোদিত?-আইনুল বারী

আল্লাহ সব কিছু দেখেন, সবকিছু শোনেন, আল্লাহ প্রকাশ্য ও গোপন সব কিছুর স্বাক্ষীঃ বিশ্বাস ও অবিশ্বাস -আইনুল বারী