সত্য অনুসন্ধানী ধার্মিকের চোখে নাস্তিক্যবাদী সংশয় ঘৃণার বস্তু নয়, কেননা জ্ঞানের সংশয়ে পাপ নেই, জ্ঞান চর্চায় ঘৃণা বিদ্বেষের প্রয়োজন নেই -আইনুল বারী
১০২.সত্য অনুসন্ধানী ধার্মিকের চোখে নাস্তিক্যবাদী সংশয় ঘৃণার বস্তু নয়, কেননা জ্ঞানের সংশয়ে পাপ নেই, জ্ঞান চর্চায় ঘৃণা বিদ্বেষের প্রয়োজন নেই
-আইনুল বারী
----------
সত্য
অনুসন্ধানী ধার্মিকের চোখে নাস্তিক্যবাদী সংশয় ঘৃণার বস্তু নয়, কেননা জ্ঞানের সংশয়ে পাপ নেই, জ্ঞান চর্চায় ঘৃণা বিদ্বেষের প্রয়োজন নেই ।
(১) অথচ আমরা এমন ধার্মিকতার শিক্ষায় অভ্যস্ত যেখানে ধার্মিকের কাছে
নাস্তিকতার চিন্তা-ভাবনা পাপের মতো,
অস্পৃশ্য।
সমাজে প্রভাব শালী, প্রতিপত্তিশালী, কঠোর ভাবাপন্ন ধার্মিকেরা মনে করে নাস্তিকতা অপ্রয়োজনীয় ও অতিশয় ক্ষতিকর
বিষয়। যদিও সমাজে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উদার মনের যুক্তিবাদী ধার্মিক রয়েছে, যারা নাস্তিকতার যুক্তি খন্ডনে তৎপর থাকেন, কিন্তু তা্রাও অনেকে নাস্তিকতাকে ক্ষতিকর বিষাক্ত সংক্রামণ বিবেচিত করে
সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে চায়। নাস্তিকতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির এই সামগ্রিক নেতিবাচকতা
কিন্তু ঠিক কাজ নয়। যদি নাস্তিকতার
বুদ্ধিবৃত্তিক তত্ত্বানুসন্ধানকেও বিশ্বাসের জায়গা থেকে কাজে লাগানো যায়, তবে তা ধার্মিকের আত্মোপলব্ধিকে চিন্তাগত দিক থেকে আরও গভীর করতে পারে।
চিন্তার যুক্তিবাদী অনুসন্ধান দ্বান্দ্বিকতার সূত্র মেনে চলে, থিসিস-এন্টিথিসিস-সিনথেসিসের শৃঙ্খলে,
যতোক্ষণ না
সংশয়বাদী মনে আরও প্রশ্ন থাকে। সত্যকে জানার উদ্দেশ্যে সংশয়বাদী মন, আর মনের প্রশ্ন অন্যায় ও অবৈধ কিছু নয়,
হতে পারে
না। তাই কুর’আনের শিক্ষা্র সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার দ্বন্দ্ব নেই, থাকতে পারে না। ইস্লামে তাই মুক্ত বুদ্ধির চর্চার স্পেস নিশ্চয় আছে।
(২) কুর’আনের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের চিন্তা-ভাবনা
ও দার্শনিক অনুধ্যানের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
পবিত্র কুর’আনে আছেঃ 'আমার প্রতিপালক প্রত্যেক বস্তুকে জ্ঞান
দ্বারা পরিবেষ্টন করে রেখেছেন।'-সূরাহ আন'আম(অধ্যায়-৬),আয়াত-৮০(১৯-২৩)
আল্লাহ
বলেছেন, ‘তুমি এমন বিষয়ের অনুসরণ করো না (অন্ধভাবে
মেনে নিয়ো না) যে বিষয়ে তোমার জানা নেই;
কান, চোখ ও মন সহ প্রত্যেকটির ব্যাপারে প্রত্যেকে জিজ্ঞাসিত হবে।’ -সুরাহ আল-ইসরা (বনী ইসরাইল),
আয়াত-৩৬
'তারা কি কুর'আন নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তা করে না? না তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?' -সূরাহ
মুহাম্মদ, অধ্যায়-৪৭ আয়াত-২৪
'এটি এই নয় যে চোখগুলি অন্ধ,
অন্ধ সে
হৃদয়গুলি।' -সূরাহ য়াল-হজ (অধ্যায়-২২),আয়াত-৪৬
‘তিনি আপনার কাছে প্রত্যাদেশ করেছেন এই গ্রন্থ; এর কিছু আয়াত সুস্পষ্ট যা গ্রন্থের মূল ভিত্তি, আর বাকি অংশ অস্পষ্ট বিবিধ অর্থবোধক,
কাজেই
যাদের হৃদয়ে বিচ্যুতি আছে তারা অস্পষ্ট আয়াতের বিভিন্ন অর্থ খুঁজে বেড়ায়; আর অনুন্ধান করে সে সবের গোপন অর্থ। কিনতু এর গোপন তত্ত্ব আল্লাহ ছাড়া কেউ
জানে না। গভীর জ্ঞানের অধিকারী যারা তারা বলেঃ আমরা তা বিশ্বাস করি, এসবই আমাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে এসেছে;
কেবল মাত্র
বুদ্ধিমানরা ছাড়া অন্য কেউ তা মানে না।’-সুরাহ আল
ইমরান, আয়াত-৭
‘তাদের মতো হয়ো না, যারা বলে যে, আমরা শুনেছি, অথচ তারা শোনেনা।' ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে তারাই নিকৃষ্ট জীব,
যারা বধির
ও মূ্ক, যারা অনুধাবন করে না।’ -সুরাহ আন’ফাল(অধ্যায়-৮), আয়াত-২১,২২
যে
চিন্তা-ভাবনা করে না, কোনো বিষয়ের অন্ধ অনুকরণ করে, সে বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরের একেবারে নিচের দিকে অবস্থান করে, আল্লাহ বলেছেন এরা সৃষ্টির অধম। যদি বুদ্ধিচর্চার অনুমোদন থাকে, তবে তা হতে হবে অবারিত। কিছু কান্ডজ্ঞান সম্পন্ন যুক্তিবাদী মানুষের কাছে
ধর্মের আহ্বানকে পৌঁছুতে হলে বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশ্নের উত্তর দিতে হব, যে পর্যন্ত না প্রশ্নকারীর মনে পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি আসে, এতো দোষের কিছু নয়। ধর্মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন আসতে পারে, সে প্রশ্নগুলি নাস্তিকতার অবস্থান থেকে হতে পারে, এটিই স্বাভাবিক। প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ নিজের মনে জানার আকাঙ্ক্ষা অথবা
দ্বিধা-সন্দেহের বীজ বোপন করে রাখা,
এটিও
অসততা। সকলেই জানে, সব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই, যুক্তি ও বিজ্ঞান সেখানে হার
মানে। তাই বলে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে এড়িয়ে যেতে হবে, এতো কিছুতেই ধর্মের অনুপ্রেরণা হতে পারে না। পবিত্র বিশ্বাস বলে কথা আছে, জ্ঞান অর্জনের ক্ষমতাও মানুষের আছে। বিবেক ও বোধ নিয়েই মানুষের নৈতিক ও
বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন যাপন।
(৩) কিন্তু নাস্তিকতাকেও বিজ্ঞ বিশ্বাসীর ভালোভাবে জানা উচিত। নাস্তিকতার
দর্শন নিঃসন্দেহে তাকে ধর্মের সত্যকে বুঝতে সাহায্য করবে। যদি না করে তবে বুঝতে
হবে বিশ্বাসের কোথাও অপূর্ণতা রয়েছে;
তখন অন্ধ
বিশ্বাসে নয়, পবিত্র বিশ্বাসে প্রতীক্ষায় থাকা
বাঞ্ছনীয়। এক সময় হয়তো নাস্তিকতার অন্ধকরাচ্ছন্ন
সমস্ত জগত বিশ্বাসীর সত্য জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হতে পারে। যে বিশ্বাসী আল্লাহের মহা অনুগ্রহ লাভ করেছে,
তার পক্ষে
নাস্তিকতার প্রশ্নবাণ ভীতিকর হতেই পারে না। কেননা সে এমনভাবে সত্যকে জেনেছে, যার গভীরতা
মাপার যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়নি। নিয়মানুসারেই কখনো কখনো বিজ্ঞান যুক্তির কাছে হেরে
যায়, যুক্তি সজ্ঞার কাছে, তবে সত্য জ্ঞান অবিচল থাকে।
(৪) সামান্য অথবা জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে ভীত হয়ে এড়িয়েছে বলে অনেকে এক সময় বিশ্বাস হারিয়ে নাস্তিক হয়ে গেছে। অথচ একজন বিশ্বাসী যখন কুর’আনের আয়াত নিয়ে ভাববে, যখন মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাববে,
যখন সৃষ্টি
রহস্য নিয়ে ধ্যানমগ্ন হবে, তখন কি তার অনুসন্ধানী মনে নাস্তিকতের
যুক্তিবাদী প্রশ্নগুলিও আসতে পারে না?
নিশ্চয়
পারে। এতো ধর্মবিশ্বাসের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ, অস্বীকার নয়, আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়া নয়, সততার সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন। ধর্ম যদি সত্য হয় তবে, ধর্ম বুদ্ধিবৃত্তিকে অস্বীকার করবে না,
বরং তা
বুদ্ধিজীবিকে জ্ঞান-রাজ্যের আরও গভীরে নিয়ে যাবে।
Comments
Post a Comment