অপব্যাখ্যাত আয়াত ৯ঃ২৯ -আইনুল

৮.অপব্যাখ্যাত আয়াত ৯ঃ২৯
-আইনুল বারী
 --  --    --

তাদের সাথে লড়াই করো যারা আল্লাহতে বিশ্বাস করে না, বিশ্বাস করে না শেষ বিচারের দিনে, আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যা কিছু নিষিদ্ধ করেছেন তা নিষিদ্ধ করে না, আর সত্য ধর্মকে মেনে নেয় না, (তারা) কিতাবপ্রাপ্ত ঐ সমস্ত লোকেদের মধ্য থেকে; যতক্ষণ না তারা নিজেদের ইচ্ছায় জিযিয়া(বিশেষ কর বা ক্ষতিপুরণ কর) প্রদান করে, বশ্যতায় (অধীনস্ততা মেনে নিয়ে)।’ -সূরাহ তওবা(অধ্যায়-৯), আয়াত-২৯

(১) জংগী গ্রুপগুলির সাহিত্যে এই আয়াতটি যে ব্যাখ্যায় পাওয়া যায়, ইসলাম বিদ্বেষী সমালোচকদের সমালোচনাতেও একই ব্যাখ্যা দেয়া হয়, তা হলো, অবিশ্বাসীদের সাথে সে পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে যে পর্যন্ত না তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং অধীনতা মেনে নিয়ে জিজিয়া প্রদান করে। কিন্তু আমার বিবেচনায় এই ব্যখ্যাটি ভুল চিন্তাপ্রসূত, অপব্যাখ্যা। কেননা আয়াতটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ঘটনার কার্যকারণ এবং কুরআনের প্রাসংগিক আয়াতগুলিকে বিবেচনায় না আনায় আয়াতের মর্মার্থ অনুধাবন করা সম্ভব হয়নি; ইসলামের জীবন দর্শনও বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।

(২) ৯ঃ২৯ আয়াতটিতে বায়জান্টাইন রোমান ও অন্যান্য (আহলে কিতাবীদের মধ্য থেকে) শত্রু পক্ষের বিরুদ্ধে মুসলমানদের লড়াইয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কুরআনে মুসলমানদের সাথে বিভিন্ন শত্রু পক্ষের যুদ্ধগুলি সংঘটিত হয়েছিলো বিভিন্ন কারণে, আর সেগুলির ছিলো ভিন্ন ভিন্ন পটভূমি। সকল যুদ্ধের সমীকরণ এক নয়। তাই যুদ্ধ সম্বলিত আয়াতগুলিকে অনুধাবন করতে হলে সে সব আঙ্গিকগুলি পর্যবেক্ষণ করা বিশেষ প্রয়োজন।

৯ঃ২৯ আয়াতটির মর্মার্থ বুঝতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। এটি তাবুকের যুদ্ধের পটভূমিতে অবতীর্ণ হয়েছে। তাবুকের যুদ্ধ মুতাহ যুদ্ধের পরের ঘটনা। যখন নবী মোহাম্মদের (তাঁর প্রতি শান্তি) একজন রাষ্ট্রীয় দূত সরকারী বার্তা নিয়ে যথা স্থানে পৌঁছুনোর সময় ঐ আরব ভুখন্ডের দখলদার খৃষ্টীয় শাসক তথা রোমান শত্রু পক্ষ তাকে হত্যা করে। এই দূতের নাম ছিলো হারিথ ইবন উমাইর আল আজদি। তার প্রতি নির্দেশ ছিলো সিরিয়ায় রোমান সম্রাটের কাছে বা বুশরার কাছে পত্র্টি পৌঁছে দিতে, কিন্তু পথে আল বালকার গভর্নর শারহাবিল ইবন অমর আল ঘাসানির হাতে আটক হন এবং অন্যায়ভাবে খুন হন। আল বালাকের ঘাসানি ছিলেন বায়জান্টাইনের শাসক সিজারের সহযোগী পক্ষ। এটি ছিলো হৃদয় বিদারক ঘটনা এবং শুধু ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, বরং একটি বড় রকমের রাষ্ট্রীয় অপরাধ। এই অপরাধমূলক হত্যাকান্ডের ঘটনাটি ছিলো একটি কার্যকারণ যা তাবুক যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে দেয়। এর প্রেক্ষিতেই ৯ঃ২৯ আয়াতটি আয়াতটি নাযিল হয়েছিলো বলে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রতীয়মান হয়।

(৩) উপরের অনুচ্ছেদটিওই আবার গুছিয়ে নেই, পুনুরুক্তি হলেও,
৯ঃ২৯ আয়াতে বর্ণিত যুদ্ধটির পটভূমি ছিলোঃ সে সময়ের পৃথিবীর সব চেয়ে বৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী সামরিক শক্তি খৃষ্টীয় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য (পূর্ব বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য) আরব উপত্যকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রীয় গোষ্ঠীগুলিকে তাদের উপবিনিবেশিক কর-অঞ্চলে তথা অধীনতার করদ রাজ্যে পরিণত করেছিলো এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক শোষণ অব্যাহত রেখেছিলো, আর তা নির্বিঘ্নে ধরে রাখতে চেয়েছিলো, কিন্তু তখন আরব উপত্যকায় ঐতিহাসিক পটভূমির পরিবর্তন ঘটে; মক্কা-মদিনাকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের নেতৃত্বে খুব দ্রুত জাতীয়বাদী ধারায় রাজনৈতিক ও সামরিক আরব শক্তি্র উত্থান ঘটতে থাকে। আরব গোত্রগুলিকে একত্রে নিয়ে আসতে থাকা এই আরব সামরিক শক্তি ও প্রো-জাতীয়াতাবাদী মুসলমান রাষ্ট্রীয় শক্তির উত্থান এক ভীতির সৃষ্টিকরে, তাই এর উত্থান রোধে বাইজান্টাইন রোমান শাসক শ্রেণী ও তার অনুগত পক্ষের পরিকল্পনা ছিলো, আরব ভূমিতে মুসলমানদের বেশি দূর এগুনোর আগেই তাদেরকে ধুলিস্যাত করে দিতে হবে। তাদের পরিকল্পনা ও সামরিক তৎপরতা শুরু হয়। এমন প্রতিহিংসাপরায়ণ আক্রমণের পরিকল্পনা ও তৎপরতার বিরুদ্ধে অপেক্ষাকৃত দূর্বল প্রতিপক্ষ মুসলমানদের বিরুদ্ধে অসাধারণ স্পৃহা জাগিয়ে তুলে সর্বাত্মক প্রতিরোধ লড়াইয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে কুরআনের ৯ঃ২৯ আয়াতে, সেই খৃষ্টীয় বাইজা্নটাইন সাম্রাজবাদী আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে, যারা ধর্মে খৃষ্টান হলেও যাদের অভিলাষ ছিলো মূলত রাজনৈতিক, তারা নিজেদের খৃষ্টান বলে অথচ
আল্লাহতে বিশ্বাস করে না, শেষ বিচারের দিনে বিশ্বাস করে না, আল্লাহ ও রাসুলের বিধি-নিষেধ মেনে চলে না, সত্য ধর্ম গ্রহণ করে না;
এবং লড়াইয়ের নির্দেশ ততোক্ষণ পর্যন্ত যতোক্ষণ পর্যন্ত না তারাপরাজয় মেনে নিয়ে নিজদের ইচ্ছায় বিশেষ ক্ষতিপূরণ কর(জিজিয়া) প্রদানে মনস্থ করে।

(৪) ৯ঃ২৯-এ স্পষ্টতই এ লড়াই মূলত প্রতিরোধমূলক; একটি প্রতিরোধ-যুদ্ধ যুদ্ধের মধ্যেই বেড়ে উঠেছে আক্রমণাত্মক হয়ে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ন্যায় যুদ্ধই থেকেছে। প্রতিটি যুদ্ধই শেষ পর্যন্ত একটি বোঝাপড়ার চুক্তিতেই সমাপ্ত হয়। সেখানে পরাজিত পক্ষ বশ্যতা স্বীকার করে ও ক্ষতিপূরণ দেয়। এই আয়াতে আক্রমণকারী রাজনৈতিক শক্তিকেই পরাস্ত করার অনুপ্রেরনা রয়েছে, ঐ অঞ্চলের সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে বা কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তাদের ধর্বিমশ্বাসের অপরাধে যুদ্ধ ছিলো না সেটি।

(৫) এখন, একটি প্রতিরোধ যুদ্ধকে ধর্ম প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে?
বিজিত অঞ্চলের স্থানীয় মানুষদের জোরপুর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার করার কোনো ইংগিত নেই ৯ঃ২৯ আয়াতটিতে না অন্য কোনো আয়াতে, এটি অপব্যাখ্যাকারীদের কল্পনা। বরং কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন দ্বীনের ব্যাপারে জোরজবরদস্তি করা উচিত নয়। মানুষকে সব চেয়ে ভালো উপায়েই ইসলামের পথে আহবান জানাতে হবে। আর যাই হোক মানুষের ধর্মবিশ্বাস যুদ্ধের মাধ্যমে, ভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রহণ করা সম্ভব নয়; বোধ-বিবেক ও হৃদয়ের অনুমোদনের উপরতো জোরজবরদস্তি চলে না। আত্মোপলব্ধি ছাড়া মানুষ বিশ্বাস অর্জন করবে কীভাবে?


তাই যুক্তিবোধ ও কুরআনের আয়াতগুলিকে সতর্কভাবে পাঠ করলে স্পষ্ট হয়ে উঠে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক-সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে ৯ঃ২৯ আয়াতের আহ্বানটি ছিলো ন্যায় যুদ্ধের, ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য বা অর্থনৈতিক শোষণের উদ্দেশে কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আক্রোশে চাপিয়ে দেয়া কোনো অন্যায় যুদ্ধ নয়।

Comments

Popular posts from this blog

'শুন হে মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।' : আমি মানুষ বনাম আমি মুসলমান-আইনুল বারী

অপব্যাখ্যাত আয়াত ৪ঃ৩৪- স্ত্রীকে প্রহার করা কি ইসলামে অনুমোদিত?-আইনুল বারী

সত্য অনুসন্ধানী ধার্মিকের চোখে নাস্তিক্যবাদী সংশয় ঘৃণার বস্তু নয়, কেননা জ্ঞানের সংশয়ে পাপ নেই, জ্ঞান চর্চায় ঘৃণা বিদ্বেষের প্রয়োজন নেই -আইনুল বারী