অপব্যাখ্যাত আয়াত ২:১৭৮, ‘কিসাস’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা। -আইনুল
১১.অপব্যাখ্যাত আয়াত ২:১৭৮,
‘কিসাস’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা।
-আইনুল বারী
-আইনুল বারী
--------------------
‘তোমরা
যারা বিশ্বাস এনেছো! নিহতদের
ব্যাপারে
তোমাদের জন্য কিসাস গ্রহণ করা বিধিবদ্ধ ছিলো
এমন যেঃ স্বাধীন
ব্যক্তি বদলে স্বাধীন ব্যক্তি, দাসের বদলে দাস ও নারীর বদলে নারী। তথাপি তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে কেউ যদি কিছু মার্জনা করে দেয়, তখন তা যেনো হয় ব্যাবহার উপযোগীভাবে ও সুন্দরভাবে। এটি তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ
হতে থেকে মার্জনা ও
বিশেষ
অনুগ্রহ। এরপর যারা
সীমা অতিক্রম করে তাদের জন্য রয়েছে যে বেদনাদায়ক শাস্তি।’-সূরাহ
বাক্বারাহ(অধ্যায়-২),আয়াত-১৭৮
কিসাস
সম্পর্কিত ২:১৭৮ আয়াতটি একটি বহুল অপব্যাখ্যাত আয়াত। এই
আয়তটি নাযিলের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি মদিনার শুরুর দিকের, যখন মদিনায় বসবাসরত
ইহুদী গোত্রেসমূহের(বিশেষত বনু
আউস ও বনু খজরাজ গোত্রের মধ্যে যে যুদ্ধ-বিগ্রহ চলে আসছিলো তার
অমীমাংসিত বিষয়ে উদারনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য) দ্বন্দ্ব সংঘাত নিরসনের
ক্ষেত্রে কিসাস পদ্ধতিতে সংস্কারের নির্দেশনা আসে আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে। কিসাস
পদ্ধতিতে গোত্রীয় সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যক্তির জন্য রক্তমূল্য পরিশোধের
ক্ষেত্রে যে বিধি চালু ছিলো, এই আয়াতে সেই(রক্তমূল্য পরিশোধের)বিধিতে উদারনৈতিক
সংস্কার আনায়নের কথা বলা হয়েছে। কিসাসে যে প্রতিশোধের যে বিধিমালা চালু ছিলো আধুনিক
যুগের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী সভ্যতার মানদন্ডে তা সার্বজনীন মানবাধিকার পরিপন্থী
বলে বিবেচিত মনে হবে। কেননা গোত্রীয় কিসাস বিধিতে নির্বিচারে যে কোনো পুরুষের বদলে
পুরুষ, নারীর বদলে নারী ও দাসে বদলে দাসকে হত্যার বা (সে অনুপাতে) রক্তমূল্য
পরিশোধের অনুমোদন দেয়। যেখানে এক দিকে অপরাধী পার পেয়ে যাবে অন্য কোনো নিরীহ
প্রাণের বিনিময়ে; অন্য দিকে পুরুষ, নারী, দাস- এই তিনভাগে মানুষকে বিভক্ত করে দেখা
হয়, তা কখনোই আজ সমর্থনযোগ্য নয়।
তথাপি
আয়াতটির মর্মার্থ বুঝতে নাযিলের সময়কার ঐতিহাসিকতা ও আয়াতের পটভূমিকে বিবেচনায় আনা
প্রয়োজন। ইসলামের আবির্ভাবের আগে থেকেই গোত্রীয় শ্রেণী বিভক্ত আরব সমাজে দ্বন্দ্ব-বিবাদে, যুদ্ধ-বিগ্রহে কিসাস পদ্ধতি
গোত্রীয় মূল্যবোধ হিসেবে চালু ছিলো। কিসাসের বিধি কেবল গোত্রীয় নৈতিকতা তথা
মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই গোত্রীয় সামাজিক মূল্যবোধে ব্যক্তি মানুষের
মূল্যকে আলাদা অর্থে নিরূপন করতো না, বরং তা ছিলো গোত্রীয় সত্তারই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ব্যক্তি মানুষ গোত্রীয়-সমাজদেহের এক একটি কোষের মতোই, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র
আত্মপরিচয় যেখানে গৌণ ব্যাপার, এবং গোত্র রক্ষায় নিয়োজিত গোত্রপতিদের শাসনের
নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই যুদ্ধ-বিগ্রহের নীতি মূলত গোত্র নিরাপত্তাবোধ থেকে উৎসারিত
হতো, ব্যক্তি মানুষের অধিকারের চেয়ে গোত্র-সত্তার নিরাপত্তা ও বাইরের আক্রমণ থেকে
তার টিকে থাকার অধিকার অগ্রগণ্য ছিলো।ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ তখনো সামাজিক
মূল্যবোধ হিসেবে আবির্ভুত হয়নি।
পক্ষান্তরে,
গোত্রীয় সমাজ থেকে যখন জাতি সত্তার উম্মেষ ঘটে ও রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন হয়, তখন
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী সভ্যতারও উম্মেষ ঘটে। এ রূপান্তরে ব্যক্তি গোত্রের স্থানে
রাষ্ট্রের বিধি প্রতিষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের বিধিও পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ কিসাসের যে
বিধি তার সংস্কারের অনিবার্য বাস্তবতা দেখা দেয়।
আরব
ভূমিতে সেদিন ইসলামের আবির্ভা্বের পর সুগভীর সামাজিক আলোড়নের মধ্য দিয়ে। এক নীরব
বিপ্লবের মাধ্যমে গোত্রীয়-সমাজ ভেংগে গোত্রের চেয়ে বৃহত্তর সামাজিক সংগঠন হিসেবে
জাতি রাষ্ট্র গড়ে উঠে। আর তখনই পুরাতন গোত্রীয় মূল্যবোধের স্থানে ব্যক্তি
স্বাতন্ত্রবাদী চিন্তার সুযোগ তৈরি হয়, জাতিগত সত্তার উন্মেষ ঘটে। গোত্রীয় আভ্যন্তরীণ
নিরাপত্তা ও শান্তি-শৃংখলা বজায়ের ক্ষেত্রে বা যুদ্ধের নৈতিকতায় এক গোত্রের কোনো সদস্যের হত্যাকান্ড বা
গুরুতর অপরাধের বিপরীতে অন্য গোত্রের যে কোনো সদস্যকে প্রতি তুলনার মাধ্যমে যে
দ্বন্দ্বের মীমাংসা হতো, ইসলামী জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর তার আইনগত মীমাংসার ধরণ
ও নৈতিকতা পরিবর্তিত হয়। যুদ্ধের ব্যাপারে কিসাসের বিধি পরিগণিত হয় যুদ্ধে
শত্রুনিধন, যুদ্ধবন্দী, মুক্তিপণ, বন্দীদবিনিময় সম্পর্কিত বিভিন্ন বিধিতে। জাতি-রাষ্ট্রের
যুদ্ধবিধিতে পুরুষ, নারী, দাস এই বিভক্তিও বিবেচনার বাইরে চলে গেল। সেখানে শত্র
শিবিরের সৈনিক, সাধারণ সৈনিক থেকে সেনাপতি পর্যন্ত ভিন্ন আঙ্গিকে বিবেচিত হলো। এই
বিবেচনায় স্বাধীন ব্যক্তি ও দাস এরকম শ্রেণী বিভক্ত গোত্রীয়-সামাজিক পদমর্যাদার
গুরুত্ব ও অনিবার্যতা ফুরিয়ে গেল, এবং যুদ্ধ ময়দানের সৈনিকের পদমর্যাদার আলাদা
সোপান তৈরি হলো। আধুনিক যুগে শত্রু শিবিরের প্রতিপক্ষ একজন সৈনিক একজন স্বাধীন
ব্যক্তি নাকি দাস সে বিবেচনা গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
এখন,
তবে কেনো ২:১৭৮ আয়াতের পুনরায় এই কিসাসের কথা?
এটি
আমরা জানি ইসলামের আবির্ভাবের আগে থেকেই কিসাসের যে প্রচলন ছিলো সেখানে হত্যার
বিকল্প হিসেবে রক্ত-মূল্যের মাধ্যমে হত্যার প্রতিশোধাত্মক বিচার সম্পন্ন হতো।
হত্যাকারী গোত্রীয় মর্যাদাপূর্ণ ও ধন্যার্ঢ ব্যক্তি হলে তার বদলের কোনো দরিদ্র
নিরীহকে জীবন দিতে হতো। রক্ত-মূল্য(দিয়াহ) নির্ধারণের ক্ষেত্রে মার্জনার কোনো নিয়ম-রীতি ছিলো না। ২:১৭৮ আয়াতের মাধ্যমে
প্রচলিত সেই বিধির সংস্কার সাধিত হয়। অর্থাৎ পূর্বের কঠোর গোত্রীয় মূল্যবোধ
বিলুপ্ত হয়। যুদ্ধনীতি ও আইন-শৃংখলা সংরক্ষণের বিধিমালা সংক্রান্ত কিছু আয়াত নাযিল
হয়। ইসলাম ধর্মের কল্যাণের ধারণার সাথে মেলালে এ সমস্ত সমাজ সংস্কারমূলক
আয়াতগুলিকে আধুনিক যুগের কল্যাণরাষ্ট্রের
ধারণার মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে নিচের দুটি আয়াত
প্রণিধানযোগ্য,
'আমি
এ গ্রন্থে তাদের জন্য নির্দেশ করেছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চক্ষুর বিনিময়ে চক্ষু, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান, দাঁতের বিনিময়ে দাঁত
এবং যখমের বদলে সমান যখম। কিন্তু যে (বদান্য হিসেবে) ক্ষমা করে, তার পাপ মোচন হয়। যে সব
মানুষ আল্লাহর প্রত্যাদেশ অনুযায়ী তদনুযায়ী বিচার করে না তারা বিভ্রান্ত।'-সুরাহ মাইদাহ, ৫:৪৫
'...ঐ প্রাণ কেড়ে নিয়ো না যা আল্লাহ পবিত্র করেছেন,আইন ও বিচারের পথ ছাড়া।
এভাবেই তিনি তোমাদের নির্দেশ করেন, যেনো তোমরা প্রজ্ঞা লাভ
করতে পারো।'-সুরাহ আন'আম, ৬:১৫১
গোত্রীয় সমাজিক
মূল্যবোধ যে কিসাস পদ্ধতিকে বিধিবদ্ধ করেছিলো তাতে হত্যার বদলা হত্যার
প্রতিশোধাত্মক শাস্তির বিকল্প হিসেবে রক্তমূল্য পরিশোধের মাধ্যমে নিষ্পত্তির যে
বিধান চালু ছিলো, সেখানে আল্লাহর অনুগ্রহ হিসেবে রক্তমূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে দন্ড
মার্জনা ও ক্ষমার যে সুযোগ তৈরি হলো তার তাৎপর্য সুগভীর। কেননা এই ক্ষমা দানশীলতার
অন্তর্গত হয়ে সম্পূর্ণ দন্ড মওকুফের সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত। এ প্রসংগে সূরাহ
আশ-শুরা কয়েকটি আয়াত,
‘আর অন্যায়-অত্যাচারের
প্রতিফলতো অনুরূপ অন্যায়-অত্যাচারই হয়;
তথাপি যে ক্ষমা করে ও বিরোধ মিটিয়ে ফেলে (/শান্তি স্থাপন করে),
তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে;
নিশ্চয় তিনি অত্যাচারীদেরকে পছন্দ করেন না।’
'আর যে নির্যাতিত হওয়ার
পরে অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয় (প্রতিরোধ গড়ে তোলে)তাদের বিরুদ্ধে
অভিযোগ নেই।’
'অভিযোগতো তাদের
বিরুদ্ধে যারা মনুষের উপর অত্যাচার-নির্যাতন চালায় ও অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে
বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’
'আর নিশ্চয় যে ধৈর্য
ধারণ করে ও ক্ষমা করে দেয় তা হবে এক দৃঢ়তারই কাজ।'
(সুরাহ
আশ-শুরা(অধ্যায়-৪২),আয়াত-৪০-৪৩)
Comments
Post a Comment