ইসলামের মানব দর্শন -আইনুল
৩৮.ইসলামের মানব
দর্শন
-আইনুল বারী
যদি আমরা
ইসলামের মানবদর্শনকে বুঝি তবে আনুষঙ্গিক অনেক কিছুই বুঝতে সহজ হয়ে যায়। তাই আমার
নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা থেকে একটা লেখা এখানে দিচ্ছি। লেখাটির শিরোনাম দিয়েছি, ইসলামের
মানব দর্শনঃ
(১) ইসলাম ধর্ম মতে সৃষ্টি জগতের একজন মহান স্রষ্টা ও প্রতিপালক আছেন, এবং তাঁর ইচ্ছার কাছে বিনীত আত্মসমার্পণ করাই প্রকৃত মানব ধর্ম। কিন্তু
সংশয়বাদী প্রশ্ন আসতেই পারে, কেনো করতে
হবে এই আত্ম-সমার্পণ? কেনো সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে
নাই-এটাই মানব ধর্ম নয়? 'আল্লাহর কাছে আত্মসমার্পণ' একটি সহজ কথা কিন্তু ব্যাপ্তি অনেক।এর মমার্থ হলো,পার্থিব জীবনের সব কিছুই আল্লাহর ইচ্ছা বা নিয়মের অধীনে।
(২) যুগে যুগে মানব সভ্যতা পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হয়েছে। আর ইসলাম ধর্ম
মানবজাতিকে শেখাতে চেয়েছে সভ্যতার একটি চূড়ান্ত মানবিক সত্যকেঃ মানুষ যেনো পার্থিব
জীবনের নেশার ঘোরে জীবনের মহান উদ্দেশ্য ও তা অর্জনের সত্য পথটি হারিয়ে না ফেলে।
পার্থিব জীবন হলো এক ছলনা মাত্র ও মানুষের জন্য পরীক্ষা কেন্দ্র; এখানে স্বার্থপর আত্ম-কেন্দ্রিক জীবনের উপযোগী কামনা-বাসনা ভোগ-বিলাসের
একটা মারাত্মক ঘোর বা ফাঁদ পাতা আছে । অশুভর
কুমন্ত্রণায় কুপ্রবৃত্তির দাস হয়ে মানুষ একই সমাজে পরষ্পর বিচ্ছিন্ন(alienation) হয়ে থাকে।আর মানুষ প্রলুব্ধ হয়, অমানবিক স্বার্থপর আত্ম-কেন্দ্রিক ভোগের জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সারাক্ষণ
লিপ্ত থাকে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা তার ভোগবাদী বিশ্বব্যবস্থা (ও বিশ্ব রাজনীতি)
দিয়ে একটি ত্রুটিপূর্ণ মূল্যবোধ তৈরি করে ও একেই বৈধতা দেয়। ধর্মের মূল নীতি থেকে
মানুষ ক্রমে ক্রমে অনেক দূরে সরে যায়। কীভাবে স্বার্থপর ভোগবাদী বিশ্বব্যবস্থায়
মানুষের অবমূল্যায়ন সংঘটিত হয় ও তা মানব জাতির ঐক্যের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব শান্তির বিরুদ্ধে অশুভ শক্তি কীভাবে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে তার আরও
কিছুটা বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন।
(৩) ইসলাম যুগে যুগে যে সত্য প্রচার করে তা হলোঃ একজন মানুষ আরেকজন মানুষের
প্রতিপালক হতে পারে না, একে অন্যের কাছে আরাধোনার যোগ্য হতে পারে
না। কেননা তার নিজস্ব ক্ষমতা বা মর্যাদা নেই, অন্যের কাছ থেকে প্রভুত্বের প্রশংসা পাবারও সে দাবীদার নয়, সে কোনো সম্পদের প্রকৃত মালিকও নয়। সকল ক্ষমতা, মর্যাদা ও সম্পদের মালিক একমাত্র সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত যিনি
তাঁর, আল্লাহর। সকল মানুষ তার সৃষ্টিকর্তা ও
প্রতিপালকের কাছে সৃষ্টগতভাবে সমান গুরুত্ব বহন করে।একে অন্যকে সন্মান করবে, কিন্তু আরাধোনা করবে না, উপহাসও করবে
না।মানুষের মধ্যে সাধারণভাবে একে অন্যের সম্পর্কের ক্ষেত্রে উচ্চ-নীচ, ভেদাভেদ নেই, বর্ণবাদ নেই।মানুষের মাঝে যে দৃশ্যমান
বৈষম্য বা পার্থক্য তা আপাত, তা
সৃজনশীলভাবে ও শুভ কাজে পূর্ণ ব্যবহারের জন্য। নৈতিক জীবনে সাফল্য লাভের জন্য। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতি তার ভোগবাদী জীবনদর্শন দিয়ে মানুষকে শেখাচ্ছে
মানুষে মানুষে উচ্চ-নিচ ভেদাভেদ স্বাভাবিকভাবেই আছে ও হয়তো চিরকাল থাকবে, ক্ষমতা ও মর্যাদার বন্টনও স্বাভাবিক ও চিরায়ত, তা যতোই নৈতিকভাবে মন্দ মনে হোক। মানুষ একে অন্যের উপর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েই
উন্নত নৈতিক জীবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ও আরও যাবে। কিন্তু সত্যি কি তাই? আর সত্যি কি তা সম্ভব?
(৪) ইসলামের মানব দর্শন বলে,
মানুষের
নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই।মানুষ যাকে ক্ষমতা বলে তা হলো তার দায়িত্ব। পুঁজিবাদী-ভোগবাদী জীবন দর্শনের বিরুদ্ধ অবস্থান এর। ‘মানুষের ক্ষমতা নেই’, বলতে বুঝতে হবে আক্ষরিক অর্থেই ক্ষমতা
নেই। মিশেল ফুকোর ক্ষমতা তত্ত্বকে গভীর দার্শনিকতায় পুরোপুরি নাকচ করে দেয় ইসলামের
ক্ষমতা তত্ত্ব। একে গভীরভাবে উপলব্ধি করে ও বিশ্বাস করে জীবন যাপনে তা চর্চা করা ও
লালন করার অর্থই আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা তথা আল্লাহর এবাদত করা। কিন্তু মানুষের
বিভিন্ন পদ-মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান থাকার ফলে মানুষ মনে করে তার অধিকারে পাওয়া
বা অর্জিত সেই পদ-মর্যাদা, ক্ষমতা ও সম্পদের মালিক সে নিজেই, সে নিজেকে বঞ্চিত অন্যেদের চেয়ে ক্ষমতাবান মনে করে, আর বেপরোয়াভাবে অন্যদেরকে তার চেয়ে হীন ও
অধীনস্ত মনে করে। ফলে বঞ্চিত প্রান্তিকেরাও নিজেদের অধীনস্ত ভেবে অসুস্থ স্বার্থপর
আত্মকেন্দ্রিকতার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে অবস্থার উত্তরণের জন্য। এমন প্রতিযোগিতা মানুষকে অন্যের প্রতি নিষ্ঠুর করে তোলে ও মানুষ
অমানবিকভাবে পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হতে থাকে।ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির সূচকের উন্নতি ও
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার ঘটলেও বিশ্ব মানব সমাজ সহানুভূতি ও
এম্প্যাথি হারিয়ে দ্বিধা-বিভক্তই থাকে ও সর্বস্তরে অশান্তি বিরাজ করে। আমরা যে
সার্বজনীন মানবতা ও বিশ্ব শান্তির খোঁজ করছি তা এক অধরা স্বপ্নই থেকে যায়।
(৫) মানুষ একে অন্যকে নিজেকে অন্যের চেয়ে ক্ষমতাবান ও প্রশংসার যোগ্য হিসেবে
প্রতিষ্ঠা করতে চায় এ কারণেই যে সে আজও তার প্রবৃত্তির দাস হয়ে আছে। কু-প্রবৃত্তি
তাকে ভোগ-বিলাস কামনা বাসনায় ভীষণভাবে আটকে ফেলেছে। সে এই ঘোরলাগা সুশোভিত পার্থিব
জীবনকেই চূড়ান্ত সত্য হিসেবে বেছে নেয়। পক্ষান্তরে
ইসলাম আমাদের শেখাতে চায় এর অন্তরালের আসল সত্যকে,
প্রকৃত
মানবধর্মকে। শেখায় যে,
এই পৃথিবীর
সকল ঘটনা ও মানুষ একে অন্যের জন্য কেবল এক পরীক্ষা মাত্র। নৈতিক জীবনের জন্য সতত
পরীক্ষা। শুভ-অশুভ দিয়ে সাজানো পার্থিব জীবন আমাদের
গন্তব্য নয়, এটি সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে গন্তব্যের দিকে
যাবার আগের এক আকাঁবাঁকা পথ। এই ছলনাময়ী জীবনের
প্রত্যেক ঘটনা ও মানুষের পারষ্পরিক সম্পর্ককে সুনির্দিষ্ট এক একটি পরীক্ষা হিসেবে
যদি না বুঝি তবে ব্যর্থতার ফাঁদে আটকে গেলাম। পৃথিবীতে কোনো কিছুই মানুষের নিজস্ব নয়। তাকে এ জীবনে নিজের জন্য চূড়ান্ত
ভাবে দেয়া হয় নি কিছুই-যা দেয়া হয়েছে তার সাথে নৈতিক জীবনের নানা পরীক্ষা যুক্ত
আছে। এটি বোঝা অত্যন্ত জরুরি। একজন গায়কের আশ্চর্য সুরেলা কন্ঠ ও গায়কী সে কীভাবে
নৈতিক জীবনে ব্যবহার করছে তাই তার পরীক্ষা।কিন্তু সে সেলিব্রেটি হয়ে অন্যের উপর
ক্ষমতাবান হতে চাইলে সে ব্যর্থ। একজন বিজ্ঞানী তার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে কী কাজে
ব্যবহার করতে দিচ্ছে তাই তার পরীক্ষা। সে ঔষুধ আবিষ্কার করছে নাকি মরণাস্ত্র
আবিষ্কার করছে, তার উপরই তার কর্মের নৈতিক
সাফল্য-ব্যর্থতা।
(৬) মানুষ যদি যাবতীয় সামাজিক ক্ষমতাকে নিজের অর্জিত মনে না করতো ও ভোগ-বিলাসিতায়
মত্ত না থাকতো, যদি ক্ষমতাকে ক্ষমতা মনে না করে শুধু
দায়িত্ব মনে করে মানব
কল্যাণে সব চেয়ে ভালো উপায়ে ব্যবহার করতো তবেই তার সাফল্য অর্জিত হতো। সে যদি মনে
রাখে এর জন্য সে অন্যের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ারও যোগ্য নয়। কেননা কোনো কিছুই তার
নিজস্ব নয়। সে কেবল পার্থিব জীবনের পরীক্ষায় ভালোভাবে উত্তীর্ণ হতে চায়।তবে সে
নিরহংকারী হবে, বিনীত হবে,
আল্লাহর
কাছে বিনীত আত্ম-সমার্পণকারী (মুসলমান) হবে। এটাইতো নৈতিক জীবনের সাফল্য।পার্থিব ও
পরকাল দুই জীবনেই। ব্যক্তি মানুষের ক্ষেত্রে এটি যেমন প্রযোজ্য, জাতি বা সম্প্রদায়ের জন্যও এটি তেমন প্রযোজ্য।
Comments
Post a Comment