যুদ্ধবন্দী ও দাসদের মর্যাদা ও অধিকার প্রশ্নে ইসলামের শিক্ষা কী ? -আইনুল বারী
৬১.যুদ্ধবন্দী ও দাসদের
মর্যাদা ও অধিকার প্রশ্নে ইসলামের শিক্ষা কী ?
-আইনুল বারী
------------------------------------------------------------------------
এটি একটি ব্যাপক বিষয়, এবং বিচক্ষণতার সাথেই এর আলোচনা হওয়া উচিত। যেহেতু অজস্র হাদিসের মধ্যে পরষ্পরবিরোধী উপাদান ও ব্যখ্যা রয়েছে ও কুর’আনের শিক্ষা বিরোধী বক্তব্য রয়েছে, যেগুলি অধিকাংশই আজ মিথে পরিণত হয়েছে তাই ইসলাম নিয়ে আলোচনার একমাত্র উৎস হওয়া উচিত পবিত্র কুর’আন। এখানে যুদ্ধবন্দী ও দাসদের অধিকারের প্রশ্নে ইসলামের অবস্থান কী সেটি পরিষ্কার করতেই এই প্রবন্ধ আমার ক্ষুদ্র এক চেষ্টা মাত্র।
এটি একটি ব্যাপক বিষয়, এবং বিচক্ষণতার সাথেই এর আলোচনা হওয়া উচিত। যেহেতু অজস্র হাদিসের মধ্যে পরষ্পরবিরোধী উপাদান ও ব্যখ্যা রয়েছে ও কুর’আনের শিক্ষা বিরোধী বক্তব্য রয়েছে, যেগুলি অধিকাংশই আজ মিথে পরিণত হয়েছে তাই ইসলাম নিয়ে আলোচনার একমাত্র উৎস হওয়া উচিত পবিত্র কুর’আন। এখানে যুদ্ধবন্দী ও দাসদের অধিকারের প্রশ্নে ইসলামের অবস্থান কী সেটি পরিষ্কার করতেই এই প্রবন্ধ আমার ক্ষুদ্র এক চেষ্টা মাত্র।
এক। ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে অবিশ্বাসীদের পক্ষ থেকে ঘৃণা
মিশ্রিত অভিযোগের আকারে বলা হয়,
‘ইসলাম দাসীর সাথে সেক্স করা বৈধ রেখেছে।’ যেমন সূরা নুর আয়াত ২৪।
উদ্ধৃত আয়াতগুলির মর্মার্থ বলতে এখানে দাসীর সাথে শুধু সেক্স করাটাই গুরুত্বপূর্ণ ও কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠলো ? তাই কি বোঝানো হয়েছে?
‘ইসলাম দাসীর সাথে সেক্স করা বৈধ রেখেছে।’ যেমন সূরা নুর আয়াত ২৪।
উদ্ধৃত আয়াতগুলির মর্মার্থ বলতে এখানে দাসীর সাথে শুধু সেক্স করাটাই গুরুত্বপূর্ণ ও কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠলো ? তাই কি বোঝানো হয়েছে?
সূরাহ নিসা(অধ্যায়-৪)এর ২৪ নং আয়াত,
পিকথলের অনুবাদটাই নিলাম,
‘And all married women (are forbidden unto you) save those (captives) whom your right hands possess. It is a decree of Allah for you. Lawful unto you are all beyond those mentioned, so that ye seek them with your wealth in honest wedlock, not debauchery. And those of whom ye seek content (by marrying them), give unto them their portions as a duty. And there is no sin for you in what ye do by mutual agreement after the duty (hath been done). Lo! Allah is ever Knower, Wise.’Pickthall,4:24
‘And all married women (are forbidden unto you) save those (captives) whom your right hands possess. It is a decree of Allah for you. Lawful unto you are all beyond those mentioned, so that ye seek them with your wealth in honest wedlock, not debauchery. And those of whom ye seek content (by marrying them), give unto them their portions as a duty. And there is no sin for you in what ye do by mutual agreement after the duty (hath been done). Lo! Allah is ever Knower, Wise.’Pickthall,4:24
'আর সকল বিবাহিত নারীও তোমাদের জন্যে(বিয়ে করা)নিষিদ্ধ;তবে তোমাদের ডান হাতের অধিকারভুক্তরা(যুদ্ধবন্দী নারী ও দাস) ছাড়া। তোমাদের জন্য এটি আল্লাহর নির্দেশ তাদেরকে ছাড়া তোমাদের জন্যে অন্য সকল নারী বৈধ করা হয়েছে,শর্ত এই যে, তোমরা তাদেরকে যৌতুকের বিনিময়ে পেতে চাইবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য,ব্যভিচারের জন্য নয়।অতএব তাদের কাছ থেকে তোমরা যা লাভ করতে (বিবাহিত সম্পর্কের মাধ্যমে) চাও, সে জন্য তাকে তার প্রাপ্য যৌতুক প্রদান করো, আবশ্যকীয় হিসেবে। এই (আবশ্যকীয়) কর্তব্য পালনের পর তোমরা পরষ্পর সম্মতিক্রমে যা করো তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন,তিনি সর্বজ্ঞানী।' -সূরাহ নিসা(সূরাহ-৪) আয়াত-২৪
আগের আয়াতটি এর সাথে মিলিয়ে
দেখি,
‘তোমাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা, তোমাদের কন্যা, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, ভ্রাতৃকণ্যা; ভগিনীকণ্যা তোমাদের সে মাতা, যারা তোমাদেরকে স্তন্যপান করিয়েছে, তোমাদের দুধ-বোন, তোমাদের স্ত্রীদের মাতা, তোমরা যাদের সাথে সহবাস করেছ সে স্ত্রীদের কন্যা যারা তোমাদের লালন-পালনে আছে। যদি তাদের সাথে সহবাস না করে থাক, তবে এ বিবাহে তোমাদের কোন গোনাহ নেই। তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রী এবং
দুই বোনকে একত্রে বিবাহ করা; কিন্তু যা অতীত হয়ে গেছে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাকরী, দয়ালু।’ -সূরাহ নিসা(সূরাহ-৪) আয়াত-২৩
এই আয়াতের মর্মার্থ কী? পূর্ববর্তী
আয়াতগুলি পর্যালোচনায় নিলে বোঝা যায় যে এখানে কোন শ্রেণীর নারীদের সাথে বিবাহ
বন্ধন করা ইসলামের শিক্ষায় নিষিদ্ধ বা অবৈধ বা আইনানুগ হবে না সে সম্পর্কে বর্ণনা
করা হয়েছে।সকল বিবাহিত (সধবা)নারী বিবাহ সম্পর্কের জন্য নিষিদ্ধ বা অনপুযুক্ত হলেও
দাসী বা যুদ্ধবন্দী বিবাহিত নারীদের ব্যাপারে বলা হয়েছে তারা বিবাহিত হলেও তাদেরকে
বিয়ে করা বৈধ হবে। কিন্তু এখানে কী বলা হয়েছে, দাসীরা শুধুমাত্র সেক্স
করার জন্য বৈধ? কামনা-লালসা চরিতার্থ করার জন্য বৈধ? পরিষ্কারভাবে
তা নিষেধ করা হয়েছে। যথোপুযুক্ত
মহরানা দিয়ে বিয়েতে যুদ্ধবন্দী নারীর ইচ্ছার স্বাধীনতা দিয়ে বিয়ে করার বিধান সেই
যুগের ইতিহাসে বাস্তবতা বিচারে একটি বৈপ্লবক সামজিক সংস্কার বলতে হবে। যেহেতু
যুদ্ধবন্দীরা নিজ দেশে ফিরে যেতে পারছে না একমাত্র যুদ্ধবন্দী বিনিময় ছাড়া, সেক্ষেত্রে
তাদেরকে মুসলমানদের জন্য বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সামজিক মর্যাদা দেয়ার
বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু এই বিয়ের ব্যাপারে জোরাজুরি বা অসত উদ্দেশ্য স্পষ্টতই
নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
২৫ নং আয়াতে কী বলা হয়েছে?
‘And whoso is not able to afford to marry free, believing women,
let them marry from the believing maids whom your right hands possess. Allah
knoweth best (concerning) your faith. Ye (proceed) one from another; so wed
them by permission of their folk, and give unto them their portions in
kindness, they being honest, not debauched nor of loose conduct. And if when
they are honourably married they commit lewdness they shall incur the half of
the punishment (prescribed) for free women (in that case). This is for him
among you who feareth to commit sin. But to have patience would be better for
you. Allah is Forgiving, Merciful.’ Pickthall,4:25
‘আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্বাধীন মুসলমান নারীকে
বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে না, সে তোমাদের
অধিকারভুক্ত বিশ্বাসী যুদ্ধবন্দী/দাসীদেরকে(ডান দিকের মালিকানাধীন) বিয়ে করবে।..’
কাজেই ২৫ নং আয়াতে বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট করা হয়েছে। ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে বা উপপত্নী হিসেবে দাসী বা যুদ্ধবন্দীদের গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে । এখানে লক্ষ্যণীয় যে বিশ্বাসী দাসী বা যুদ্ধবন্দীর জন্য স্বাধীন মুসলমান পুরুষদের বিয়ের বৈধতা দেয়া হয়েছে। দাসী বা যুদ্ধবন্দীদের এই পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার ইসলামের আগে আর কোথায় ছিলো? এটি নিঃসন্দেহে মানবাধিকার প্রশ্নে একটি বৈপ্লবিক সামাজিক সংস্কার!
সাধারণভাবে নারীদের প্রতি আচরণের দিক-নির্দেশনা দেয়া
হয়েছে ১৯ নং আয়াতে,
‘O you who have believed, it is not lawful for you to inherit
women by compulsion. And do not make difficulties for them in order to take
[back] part of what you gave them unless they commit a clear immorality. And
live with them in kindness. For if you dislike them - perhaps you dislike a
thing and Allah makes therein much good.’ Sahih International,4:19
বলঅপূর্বক নারীদের অধিকার ভুক্ত করা বা আটকে রাখা এবং
অন্যায় আচরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে।তাদের সাথে সদ্ভাব করতেবলা হয়েছে।
২১ নং আয়াতে নারী-পুরুষের পারষ্পরিক অংগীকারের মূল্যায়ন
করা হয়েছে।
উপসংহারঃ-
যুদ্ধবন্দী দাসীদের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকারের প্রশ্নে
ইসলামের শিক্ষা হলোঃ-
১) তাদের সাথে জোর পূর্বক যৌন কামনা-বাসনা চরিতার্থ করা
যাবে না।
২) তাদের উপপত্নী হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।
৩) তাদের যথাপুযুক্ত সামগ্রী দিয়ে বিয়ে করা বৈধ। তবে
বিশ্বাসী যুদ্ধবন্দী/দাসীদের স্বাধীন মুসলমান পুরুষ বিয়ে করতে পারবে।
৪) যুদ্ধবন্দী নারীরা বিবাহিত হলেও তাদের বিয়ে করা বৈধ
হবে যেহেতু তারা নিজের দেশে বা পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারে না। তবে যুদ্ধবন্দী
বিনিময় করা গেলে সেটি ভিন্ন কথা। যুদ্ধবন্দী নারীদের জোরপূর্বক বিয়ে করা যাবে না, তাদের
ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকতে হবে এবং বিশ্বাসী হতে হবে। তাদের সাথে যৌন সম্পর্ক তখনই
বৈধ হবে যখন তা ইসলামের বিধি অনুসারে পালিত হবে।তাদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখতে হবে
ও প্রতিশ্রুতি বজায় রাখতে হবে।
৫)সর্বোপরি ইসলাম ধর্মে দাসমুক্তির বিধান আছে।
একজন সদাচরণশীল মুসলমান বিবাহিত যুদ্ধবন্দী যাকে দাসী
হিসেবে গ্রহণ করেছে তাকে নিঃশর্ত মুক্তিও দিতে পারে। এটি ইসলামের দৃষ্টিতে একটি
মহৎ কাজ।
৬) যতো যুক্তিই দেয়া হোক তবুও ইসলাম ধর্ম দাসব্যবস্থাকে
অনুমোদন করে এমন সমালোচনা করা হয়।এটি তো সত্য যে ইসলাম দাসব্যবস্থা্র বিরুদ্ধে
কঠোর অবস্থান নেয়নি। ইসলাম কি
পারতো না দাস ব্যবস্থাকে একেবারে নাকচ করে দিতে? নবী
ইব্রাহীম(তাঁর প্রতি শান্তি)কাবা ঘরের পৌত্তলিক মুর্তিগুলি ভেংগে দিয়েছিলেন কিন্তু
তিনি কি রাতারাতি পৌত্তলিক বিশ্বাস্কে ভেংগে দিতে পেরেছিলেন? না
পারেন নি, এর জন্য তাঁকে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হয়েছিলো। দাস ব্যবস্থা
রাতারাতি আইন করে রহিত করা সম্ভব ছিলো না, মধ্যযুগে সারা পৃথিবীর
অর্থনীতি ও রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক ছিলো দাস ব্যবসা। কিন্তু পবিত্র কুর’আনের
আয়াতগুলিতে তথা ইসলাম ধর্মের শিক্ষায় তেমন দাস প্রথাকে চিত্রিত করা হয়নি যেমন
জঘন্য ক্রিতদাস প্রথা আমরা দেখি পশ্চিমা জগতের দাস ব্যবসায় চিত্রিত হয়েছে!
যুদ্ধবন্দী ও দাস বিষয়ে পবিত্র কুর’আনে বেশ কিছু আয়াত
রয়েছে যেগুলি মনোযোগের সাথে পাঠ করলে বোঝা যায়, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা
দাসব্যবস্থার অবমুক্তি। তবে এই অবমুক্তি প্রক্রিয়াটি হয়েছে সামাজিক সংস্কারের
প্রক্রিয়ায় আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে । প্রথমে দাস ও যুদ্ধবন্দীদের
ধর্মীয়, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক
মর্যাদা ও অধিকার সমূহ বিচক্ষণতার সাথে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপর সেই সংস্কার
প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে অচিরেই দাসব্যবস্থার অবমুক্তি ঘটেছে।
৭)যেহেতু ইসলাম ধর্মে দাস প্রথা বৈধ ছিলো কাজেই আজকের
যুগেও তা বৈধ হিসেবে গণ্য হবে কিনা এমন অবান্তর প্রশ্নও আসে। একটি জিনিস বুঝতে হবে
পবিত্র কুর’আনের মাধ্যমে ইসলামের যে জীবন বিধান তার প্রয়োগ যেমন
বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন হতে পারে, এবং সেই বিভিন্নতার
সীমারেখাও আছে।নবীজীর সময়ে দাসব্যবস্থা একটি আর্থসামাজিক বাস্তবতা ছিলো, কিন্তু
আজতো তা নেই। কাজেই আজ দাসী বা যুদ্ধবন্দী রাখার সুযোগ নেই। এটি এ যুগের বাস্তবতা।
ইসলামতো দাসদের মুক্তির কথা বলেছে, তা টিকিয়ে রাখার কথা
বলেনি। দাসদের মর্যাদা ও অধিকারের কথা বলেছে, তাদের অধিকার হরণের কথা
বলেনি। এটিই ইসলামের প্রজ্ঞা।
Comments
Post a Comment