অপব্যাখ্যাত আয়াত-৫ঃ৩৩ -আইনুল বারী
৫৮.অপব্যাখ্যাত আয়াত-৫ঃ৩৩
-আইনুল বারী
-----------------------------
সুরাহ মাইদাহ’র ৩৩ নং আয়াতকে কেউ কেউ ভুল ভাবে ব্যখ্যা করে প্রচার করছেন যে আল্লাহ ও রাসুলের নামে কূটোক্তিকারীদের হত্যার শাস্তির অনুমোদন এই আয়াত থেকে পাওয়া যায়। যা এক বিপজ্জনক ব্যখ্যা ছাড়া কিছু নয়।
প্রথমেই এটা বোঝা খুব প্রয়োজন যে, মহান আল্লাহ কুরা'আনে্র মাধ্যমে যে শিক্ষা দিয়েছেন (তা যে বার্তা ও নির্দেশ বহণ করে) তা নবী হযরত মোহাম্মদের (তাঁর প্রতি শান্তি) সময় থেকে পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত সময়ের জন্য। এ সময়ের মানুষের আধ্যাত্মিক, ব্যবহারিক, ব্যক্তিগত ও সামাজিক যৌথ জীবনের জন্য সোজা পথ প্রদর্শন করে। তবে পবিত্র কুর’আনে মহান আল্লাহ একই বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে ও পরিস্থিতিতে তার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে কাজেই বিচ্ছিন্ন ভাবে একটি আয়াত থেকে ঐ বিষয় সম্পর্কে পূর্ণাংগ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়, এর জন্য কুর’আনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে অন্তত ঐ বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করেছে এমন সব আয়াতকেই মিলিয়ে পড়তে হবে। একটি আরেকটির পরিপূরক হতে পারে।
নবী তাঁর সময়ের সমস্যার সমাধান করেছেন একমাত্র পবিত্র কুর'আনের আলোকে। তাঁর সময় আর আমাদের সময় এক রকম নয়। এখন ঘোড়ার পিঠে তালোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করা হয় না, এখন যুদ্ধ ও যুদ্ধের কৌশলও অনেক পাল্টেছে। আজকের সমস্যাও আগের মতো এক রকম নয়। কিন্তু আজকের যুগে কীভাবে কুর’আনের শিক্ষার প্রয়োগ হবে তার নির্দেশ আছে ঐশীগ্রন্থ কুর'আনেই। এখন আসা যাক, মাইদাহ'র এই আয়াতে ৫-৩৩। কি আছে এই আয়াতে, আবার দেখি প্রতিটি শব্দ বা কথাকে আলাদা আলাদা ভাবে চিন্তা করে। আমি এখানে দু’টি ইংরেজি অনুবাদাটা তুলে ধরছি ,
‘The
only reward of those who make war upon Allah and His messenger and strive after
corruption in the land will be that they will be killed or crucified, or have
their hands and feet on alternate sides cut off, or will be expelled out of the
land. Such will be their degradation in the world, and in the Hereafter theirs
will be an awful doom;’ (Pickthall)
‘Indeed,
the penalty for those who wage war against Allah and His Messenger and strive
upon earth [to cause] corruption is none but that they be killed or crucified
or that their hands and feet be cut off from opposite sides or that they be
exiled from the land. That is for them a disgrace in this world; and for them
in the Hereafter is a great punishment,’ (Sahih International)
‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় আর দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হচ্ছে এই যে, তারা মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত হবে অথবা শূলে চড়বে, অথবা তাদের হাত-পা সমূহ বিপরীত দিক থেকে কাটা হবে অথবা তারা দেশ থেকে বহিষ্কৃত হবে। এটি হল তাদের জন্য পার্থিব জীবনের দূর্দশা, আর পরবর্তী জীবনেও তাদের কঠোর বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে।’
তার মানে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া আর দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির শাস্তি কী কী সে সম্পর্কে এই আয়াতে বলা হয়েছে,
শাস্তিগুলি হলোঃ
মৃত্যুদন্ড,
অথবা শূলে ক্রুশবিদ্ধ,
অথবা হাত পা বিপরীত দিক থেকে কর্তন,
অথবা নির্বাসন।
আমরা জানি ক্রুশবিদ্ধ করে শাস্তি প্রদান, বা হাত-পা কর্তন বা নির্বাসন – এ
সবই অতীতে প্রচলিত শাস্তির অন্তর্ভুক্ত ছিলো। মুসা নবীর (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) সময় ফেরাউনের রাজত্বে হাত-পা বিপরীত থেকে কর্তনের শাস্তির নিয়ম-কানুন ছিলো। ঈসা নবীর (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক) সময় ক্রুশবিদ্ধ করার শাস্তি ছিলো। আর নির্বাসনের ব্যপারে বলতে হয়, এমন কি আধুনিক কালেও ভারতবর্ষে আন্দামান-নিকোবার দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসনে পাঠানোর শাস্তিমূলক বিধানের কথা আমরা জানি। সে দিনের 'নির্বাসন'কে আধুনিক রাষ্ট্রের 'কারাবাসে সমতুল্য ভাবা যৌক্তিক।কিন্তু আজকের বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রই মৃত্যুদন্ডের শাস্তি ও 'কারবাসের নির্বাসন' ছাড়া এই অঙ্গহানি বা কর্তনের শাস্তিসমূহ বলবৎ নেই। যুদ্ধ ও দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির শাস্তি কিন্তু এখনো সব দেশেই বেশ কঠিন। বিশ্বে যতো দিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় যুদ্ধের নীতি টিকে থাকবে ততোদিন শত্রু শিবিরে হানা ও শ্রত্রু নিধনকে পাপ বা অন্যায় মনে করা হবে না। গুপ্তচরবৃত্তির শাস্তিও মৃত্যু দন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হিসেবে আজও টিকে আছে।
কাজেই যেহেতু কুর’আনের আয়তগুলি শুধু একটি কালের জন্য নয় তাই এর প্রয়োগ ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন হতে পারে। বিভিন্ন কালের প্রয়োগের বিকল্পগুলি পবিত্র আয়াতেই আছে। কিন্তু এখানে এই শাস্তিগুলি কোন পরিস্থিতিতে কোন অপরাধের জন্য প্রযোজ্য এটি বুঝতে হলে আয়াতগুলি নাজিলের সময়কে অর্থাৎ সেই পরিস্থিতিকে বুঝতে হবে, যে প্রেক্ষিতে আয়াতটি নাজিল হয়েছিলো। সপ্তম শতকে নবীজীকে লুন্ঠন-নৈরাজ্য ও যুদ্ধ-বিগ্রোহের পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হচ্ছিলো, যার প্রেক্ষিতে ৫-৩৩ আয়াতটি নাজিল হয়েছিলো। একজন ধর্ম প্রচারক নবীকে বিদ্রূপ বা বিতর্কের কারণে শাস্তি হিসেবে এই আয়াত নাজিল হয়নি। নাজিল হয়েছে একজন রাষ্ট্র প্রধানকে হত্যার, তাঁকে দেশ থেকে বহিষ্কারের ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শাস্তির দিক-নির্দেশনা হিসেবে। আর শাস্তি বাস্তবায়ন কি আইন ও বিচার ছাড়াই করতে বলা হয়েছে? নিশ্চয় তা নয়। শাস্তি কার্যকর কে করবে? রাষ্ট্র করবে, নাকি কোনো গোষ্ঠী, নাকি কোনো ব্যক্তি? এ ব্যাপারগুলি ইসলামে এতো ছেলেখেলা নয় কিন্তু।
সুরা মাইদাহ’র ৩৩ নম্বর আয়াতকে শুধু ৩৩ নম্বরং আয়াত দিয়ে বোঝা যাবে না যদি না তার সাথে ৩৪ নম্বরটিও যোগ করি। ৩৪ এ লিখা আছে,
‘Save
those who repent before ye overpower them. For know that Allah is Forgiving,
Merciful.’ (Pickthall)
‘Except
for those who return [repenting] before you apprehend them. And know that Allah
is Forgiving and Merciful.’ (Sahih International)
অর্থাৎ ‘কিন্তু যারা তোমাদের হাতে আটকের/আয়ত্তে/নিয়ন্ত্রণে আসার পূর্বে অনুশোচনা করে; জেনে রাখো আল্লাহ ক্ষমাকারী, দয়ালু।’ অর্থাৎ সেক্ষেত্রে তাদের ক্ষমা করাটাই শ্রেয়। অনুশোচনাকারী ও আত্ম সমাপর্ণকারী কোনো সৈনিকের জন্য ক্ষমার এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আজকের বিশ্বেও কি কোথাও আছে?
সর্বপোরি, আল্লাহ মানুষকে রক্তপাত, অশান্তি ও যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের কষ্ট বাড়িয়ে তুলতে নির্দেশ দেননি, বরং এসবের বিরুদ্ধেই মানব জাতিকে গড়ে ওঠারই নির্দেশনা দিয়েছেন। যুদ্ধ কেবল তখনই বৈধ যদি তা ন্যায় যুদ্ধ হয়, অস্তিত্বের টিকে থাকার সংগ্রাম হয়। যদি যুদ্ধকে চিরতরে বিশ্ব থেকে মুছে ফেলা যেতো, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারতো?
Comments
Post a Comment