আল্লাহকে কেনো ভয় ? আইনুল
৪.আল্লাহকে কেনো ভয় ?
আইনুল বারী
-- --- ---
ধর্ম কর্ম পালনে এর কী প্রয়োজন?
যুক্তিবাদী সন্দিগ্ধ মনে এমন প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। উত্তরও পরিষ্কারঃ ভয় তাঁকে খুশি করার জন্য নয়, ভয় আমাদের নিজেদের অন্যায় কৃতকর্মের মাধ্যমে অর্জিত পরলৌকিক দুঃখজনক পরিণতির জন্য । আর এই ভয় এ জন্য যেনো আমরা তাঁর আদেশ পালন করতে গিয়ে অশুভকে ভয় পেয়ে পিছিয়ে না যাই ও নিজেদের পরকালকে অনাকাংখিত না করি । পৃথিবীর কোনো শক্তিকেই ভয় নয়, একমাত্র যিনি প্রতিপালক যিনি ন্যায়বিচারক তাঁকে ছাড়া। একটু বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করবো।
কেউ অস্বীকার করবে না যে আমাদের নাগরিক সমাজ থেকে সৎ সাহস একেবারে হারিয়ে যাচ্ছে। অতি মাত্রায় ভয়ের কারণে। আমরা ‘উপরের’ ধমক ও চোখ রাঙানিকে ভীষণ ভয় পাই। নিরাপত্তার ভয় আমাদের সর্বাধিক। কারো রোষানলে পড়ে যদি চাকরিচ্যুত হই পথে বসে যাবো, কাজেই মুখ বুঁজে সব রকম অন্যায় সহ্য করতে হবে, ‘উপরের’ অন্যায় নির্দেশ পালন করা ছাড়াতো গতি নেই। রুটি-রুজির ভয়ে থাকি সর্বক্ষণ । তাই ঘুষ খেতে হবে বেশি বেশি যতোটা সুযোগ পাওয়া যায় ও লোভনীয় পোস্টিং ধরে রাখতে হবে, ঘুষ দিতে হলে হবে। বড় বড় জায়গায় তদ্বির করতে হবে,তদ্বিরের মোক্ষম চ্যানেল তৈরি করতে হবে। শক্তিশালীদের অবৈধ সুযোগও দিতে হবে এজন্য। ঝকঝকে শপিংমল, ক্লাব-বার ও প্রাসাদ দেখলে ভয় পাই। কারণ ওসব সমাজের উপরতলার তাদের জন্য যারা আমার মতো চুনোপুটিদের খেয়ে ফেলতে পারে। পাড়া-মহল্লার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীকে ভীষণ ভয়পাই, তাই ওদের বিরুদ্ধে কখনোই সাক্ষী হই না। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পুলিশকেও কিছু বলি না কারণ, মাদক ব্যাবসায়ীরা কিলার ক্যাডার সন্ত্রাসী পালে। গড ফাদার-মাদারদের ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকি, কারণ তাদের পোষা গুন্ডারা আমাকে ও আমার পরিবারের যে কাউকে গুম করতে পারে, কিডনাপ করতে পারে, মেরে ফেলতে পারে বা আরো খারাপ কিছু করতে পারে।
এসব ভয় সৃষ্টিকারী শক্তিমান দানবীয় মানবদের নেক নজরে একটু নিরাপদে থাকার জন্য তাদের তাঁবেদারি করতে হলেও করি যেনো তারা সন্তুষ্ট থাকে। তারা সন্তুষ্ট থাকলেই কেবল আমি পরিবার-পরিজন নিয়ে ঠিক মতো শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। তাই সব অন্যায় দিনের পর দিন নীরবে সহ্য করে যাই। এবং তাদের সন্তুষ্টির জন্য তাদের পক্ষে আমার সব রকম মতামত দেই। ক্ষমতাতো তাদেরই, আমার বা আমার মতো দুর্বলদের জন্য নয়। সাম্রাজ্য তো ক্ষমতাবানদেরই। এক ভয়ংকর অশুভ শক্তি কিনে নেয় দুনিয়ার সব কিছু সুলভ মূল্যে নীতি-বিচার-আচার-আইন-অর্থ-জৌলুস-সেলিব্রেটি-মিডিয়া-ডান্ডা-বেড়ি-অস্ত্র-বারুদ, আমাদের ভয় দেখানোর জন্য।
এ কলিজা কাঁপানো ভয় ও ত্রাসের জন্য যতো বিভেদ-পীড়ন-দূর্যোগ-অনাচার দূর হচ্ছে না। এ ভয়ের কারণেই পৃথিবীর সব মানুষ সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এক হচ্ছে না। এ ভয় আমাদের বিবেকের দংশনে প্রতিদিন ক্ষত-বিক্ষত করছে। এ ভয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সৎ সাহসটুকু কেড়ে নিচ্ছে।আমরা বিশ্বময় বা নিজ দেশে যে মায়াবী মানবতার অনুসন্ধান করি, যে অনাবিল ভালোবাসার গল্পের খোঁজ আমরা করি, তা সত্যি পেয়ে যেতাম যদি এমন ভয় বিপজ্জনক আততায়ীর মতো সারাক্ষণ আমাদের তাড়া না করতো।
আমরা এ সব ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তিকে এতো বেশি ভয় পাই যে তাদের সামনে হাজির হলে আমাদের সমস্ত অস্তিত্ব অটো- এলার্ট হয়ে যায় এবং আমাদের ধ্যান-জ্ঞান মগ্ন থাকে তাঁদের বচন ও তীর্যক ইঙ্গিতের দিকে। আমরা তাদের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেও ভয় পাই। আমরা তাদের সামনে কথা বলি অনুনয়, বিনয়, প্রার্থণার সুরে। বলা উচিত আমরা প্রকারন্তরে ক্ষমতাবানদের মধ্যে এক ধরণের দেবত্ব আরোপ করি। শিরকের মতোই বড় অপরাধ করে ফেলি। অথচ আল্লাহর সামনে নামাযে উপস্থিত হতে গিয়ে ভয়হীন অন্যমনষ্ক এলোমেলো থাকি। ভুলে যাই যে এ জীবন আমাদের জন্য একটা পরীক্ষা, সকল কৃতকর্মের বিচার একদিন হবে, আমাদের একটা পরকাল আছে। সে পরকালের ভয় কতো বড় হওয়া উচিত?
পবিত্র কুর’আনে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ সৎ কাজের আদেশ করেছেন এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এবং কেবল মাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই সৎ কাজ করে যেতে বলেছেন। আমরা যদি আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তাঁকে ছাড়া অশুভ শক্তিকে বিন্দুমাত্র ভয় না করতাম, যদি নিজের বা নীতিহীন সে সব ক্ষমতাবানদের সন্তুষ্টির জন্য চিন্তা না করে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নেক আমল করে যেতাম, আমরা যদি বিত্ত-বৈভব-পদ-পদবীকে একান্ত নিজেদের সম্পদ মনে না করে ভাবতে পারতাম এসবের মালিক একমাত্র আল্লাহ -তবে এ পৃথিবীটা সত্যি এক অপূর্ব আনন্দময় শান্তি নিকেতন হয়ে উঠতো!
আল্লাহ এমন এক 'সবার উপরের' শক্তিমান ও পরম করুণাধারায় সিক্ত অস্তিত্বময়তা যার কাছে প্রার্থণার প্রয়োজনীয়তা এটাই যে, সে প্রার্থণা মানুষের গভীর অন্তকরণ থেকে উৎসারিত হয়, এ হলো এমন এক আশ্রয় যা মানুষকে বারবার আশাবাদী হয়ে উঠতে সাহায্য করে, বিপদ কাটিয়ে নতুনভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়, মানুষকে দেয় নিজের প্রতি সত্যিকার আত্ম -বিশ্লেষণের সুযোগ। আল্লাহর সর্ব জ্ঞানময়তা ও পরম শক্তিময়তার সামনেই কেবল মানুষ কোনোরূপ চালাকির সুযোগ পায় না, তাই সে সবচেয়ে নিরপেক্ষ, নির্ভেজাল, বিনীত ও সত্যবাদী হয়ে থাকে; যদি সে বিশ্বাসী হয়। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও ভয়ের প্রয়োজনীয়তা এটাই যে, এ ভালোবাসা ও ভয় প্রত্যেক মানুষের অন্তকরণে এমন এক সাহস যোগাবে যা ক্ষুদ্র জীবন-যাপনের মাঝে আসা অনবরত অন্যায় ও অশুভ শক্তির ভয় কাটিয়ে উঠতে সৎ সাহসের শক্তি যোগাবে। আর এভাবেই যাবতীয় অন্যায়- পাপাচার থেকে আত্মাকে নিরাপদ ও পবিত্র রাখবে।
আল্লাহ পবিত্র কুর’আনে কতো জায়গায় এমন কথা বলছেন, ‘শয়তানই তার বন্ধুদের দিয়ে তোমাদের ভয় দেখায়;তোমরা তাদেরকে ভয় করো না আমাকে ভয় করো; যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।’ -সুরাহ ইমরান,আয়াত-১৫১
‘হে বিশ্বাসীরা! আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় খুঁজো, তার পথে সংগ্রাম করো, যেনো সফলকাম হও।’-সুরাহ মা-য়িদাহ, আয়াত-৩৫)
‘আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? আর তারা আপনাকে আল্লাহ ছাড়া অন্যদের ভয় দেখায়! যাকে আল্লাহ দূরে ঠেলে দেন তার কোনো পথ প্রদর্শক নেই।’-সুরাহ যুমার, আয়াত-৩৬
‘যেদিন তাদের চেহারা বিবর্তিত হবে, বলবে, হায়! যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে মানতাম! এবং বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! নেতা ও বড় মানুষকে আমরা মেনেছি, তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে। হে আমাদের রব! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দাও! তাদের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করো, বড় অভিশাপ।’-সুরাহ আহযা-ব, আয়াত-৬৬ থেকে ৬৮)
‘আল্লাহ বলবেন আজকের দিনে সত্যবাদীরা সততার জন্যউপকৃত হবে। তাদের জন্য জান্নাত, যার নিচ দিয়ে প্রবাহিত ঝর্নাধারা। আর সেখানে তারা চিরদিন থাকবে; আল্লাহ তাদের প্রতি ও তারা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট, এটাই বড়সাফল্য।’-সুরাহ আন’আ-ম, আয়াত-১১৯
Comments
Post a Comment