নবী মোহাম্মদ (তাঁর প্রতি শান্তি) মারিয়া কিবতিয়াকে বিয়ে করেছিলেন, নাকি যৌন দাসী ছিলেন? -আইনুল
৪৬.নবী মোহাম্মদ (তাঁর প্রতি শান্তি) মারিয়া কিবতিয়াকে বিয়ে করেছিলেন,
নাকি যৌন দাসী ছিলেন?
-আইনুল বারী
-- --- ---
নবী মোহাম্মদ (তাঁর প্রতি শান্তি) মারিয়া কিবতিয়াকে বিয়ে করেছিলেন,
নাকি যৌন দাসী ছিলেন সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
এর একটি বিশ্লেষণী সার-সংক্ষেপ করতে চেষ্টা করছিঃ
(১) সূরাহ আহযাব এর ৫০ থেকে ৫২ পর্যন্ত আয়াতগুলি বিবেচনায় নিয়ে সমালোচকরা বলেন,
৩৩ঃ৫২ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহ নবী মোহাম্মদকে উদ্দেশ্য করে বলছেন যে, এরপর আর কোনো নারীকে বিয়ে করা তাঁর জন্য বৈধ হবে না। এখন, যেহেতু এই আয়াত নাযিলের(ধারণা করা হয় সূরাহটি নাযিল হয়েছিলো হিজরী ৫ সালে অর্থাৎ ৬২৭ খৃঃ-এ খন্দকের/পরিখা যুদ্ধের পটভূমিতে) পরই মারিয়া কিবতিয়াকে নবী উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন, কাজেই মারিয়া নবী মোহাম্মদের বিবাহিত স্ত্রী ছিলেন না, বরং একজন যৌন দাসী মাত্র ছিলেন।
(২) ইসলামী চিন্তাবিদদের পক্ষ থেকে এই দাবী প্রত্যাখ্যান করে বেশ কয়েকটি রেফারেন্স (তাবারি, ইবনে কাসির ও অন্যান্য আরও কিছু) দেখিয়ে বলা হয়েছে যে মারিয়া কিবতিয়াকে নবীজী বিয়ে করেছিলেন, এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য। এমন কোনো হাদিসের উল্লেখ নেই যেখানে প্রমাণিত হয় যে মারিয়া কিবতিয়া নবীর পরিবারে একজন যৌন দাসী ছিলেন। তিনি দাসী হিসেবে উপহার পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু নবী পরিবারে তিনি বিবাহিত স্ত্রীর মর্যাদায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন।
(৩) ৩৩ঃ৫২ আয়াতটিতে পুরো অর্থ বুঝতে এর আগের ৩৩ঃ৫০টির অর্থ বোঝাও প্রাসঙ্গিক। কেননা ৩৩ঃ৫০ আয়াতটির সাথে ৩৩ঃ৫২ আয়াতটির ধারাবাহিকতা একই কন্টেক্সটের অন্তর্ভুক্ত। ৩৩ঃ৫০ আয়াতে আল্লাহ বলছেন,
‘হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীদেরকে বৈধ করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেছেন। আর দাসীদেরকে, যাদেরকে আল্লাহ যুদ্ধবন্দী হিসেবে আপনার করায়াত্ব করে দেন, আর আপনার চাচাতো বোন, ফুফাতো বোন, মামাতো বোন, খালাতো বোনকে যারা আপনার সাথে হিজরত করেছে, আর কোনো বিশ্বাসী নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে নিবেদন করে, নবী তাকে বিয়ে করতে চাইলে সেও বৈধ। এটি বিশেষ করে আপনারই জন্য-অন্য বিশ্বাসীদের জন্য নয়। আপনার অসুবিধা দূর করার জন্য। বিশ্বাসীদের স্ত্রী ও দাসীদের ব্যাপারে যা নির্ধারণ করেছি আমার জানা আছে। আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।’-সূরাহ ৩৩ঃ৫০
এরপর,
‘এরপর(আর) আপনার জন্যে কোনো বৈধ নয় এবং তাদের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করাও বৈধ নয় যদিও তাদের রূপলাবণ্য আপনাকে মুগ্ধ করে, তবে দাসীর ব্যাপার ভিন্ন। আল্লাহ সব বিষয় পর্যবক্ষণ করেন ।’-সূরাহ ৩৩ঃ৫২
যদি মারিয়া কিবতিয়া নবীর বিবাহিত স্ত্রী হয়ে থাকেন তবে ৩৩ঃ৫২ আয়াতে উল্লেখিত আর কোনো নারীকে বিয়ে না করার আল্লাহর নির্দেশ নবী কি ভংগ করছেন না? এ থেকে উত্তোরণের জন্য সমালোচকদের পক্ষ থেকে ব্যখ্যা দেয়া হচ্ছে, এই আয়াত নাযিলের পর থেকে নবীর পক্ষে আর কোনো নারীকে বিয়ে করা বৈধ ছিলো না। তবে ‘দাসীদের ব্যাপার ভিন্ন’ বলতে বোঝানো হচ্ছে, দাসীদেরকে যৌন দাসী হিসেবে উপভোগের অনুমতি রয়েছে। কোনো নারীকে বিয়ে করে যৌন উপভোগের সুযোগ নেই, কিন্তু দাসিদেরকে যৌন দাসী হিসেবে রেখে যৌন উপভোগের সুযোগ আল্লাহ দিয়েছেন। আল্লাহ দাসীদের নবীর যৌন উপভোগের বস্তু বানানোর জন্য শিক্ষা দিতে পারেন কিনা তা একটু গভীরে তলিয়ে দেখা যাক। ৩৩ঃ৫০ ও ৩৩ঃ৫২ আয়াতদুটির তাৎপর্য বুঝতে চেষ্টা করি।
আল্লাহ নবীর জন্য বৈধ করেছেন, মোহরানাপ্রাপ্ত স্ত্রীদেরকে, চাচাতো বোন, ফুফাতো বোন, মামাতো বোন, খালাতো বোনকে যারা নবীর সাথে সাথে হিজরত করেছেন, যুদ্ধবন্দী নারী ও দাসীদেরকে(তারা বিশ্বাসী হলে বিয়ে করে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা বৈধ হবে।), কোনো বিশ্বাসী নারীকেও বিয়ে করা বৈধ যদি তিনি যদি নিজেকে নবীর কাছে নিবেদন করেন। এছাড়া অন্য কোনো নারীকে নবী বিয়ে করতে পারবেন না। দাসীদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের শর্ত হলো দাসমুক্তি ও দাসীদের বৈবাহিক সম্পর্কের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। যৌন কামনা চরিতার্থ করা বা ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া নয়। নবীদের জন্য তা গ্রহণযোগ্যও নয়।
(৪) কান্ডজ্ঞানে দাস, বৈধ যৌন সম্পর্ক, বিবাহিত সম্পর্ক বিষয়ে কুর’আনের শিক্ষাকে অনুধাবনের চেষ্টা করা যাক। কেননা কুর’আনের কোনো আয়াতের শিক্ষাই সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়, একটি আয়াতের সাথে আরেকটি আয়াতের প্রাসঙ্গিকতার নির্দেশনা থাকলে তা অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে, নয়তো বিভ্রান্তি আসতে পারে। নিচের আয়াতগুলি থেকে অনুধাবন করা যায়,
‘তোমাদের জন্যে
হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতা, তোমাদের কন্যা, তোমাদের বোন, তোমাদের ফুফু, তোমাদের খালা, ভ্রাতৃকণ্যা; ভগিনীকণ্যা তোমাদের সে মাতা, যারা তোমাদেরকে স্তন্যপান করিয়েছে, তোমাদের দুধ-বোন, তোমাদের স্ত্রীদের মাতা, তোমরা যাদের সাথে সহবাস করেছ সে
স্ত্রীদের কন্যা যারা তোমাদের লালন-পালনে আছে। যদি
তাদের সাথে
সহবাস না করে থাক, তবে এ বিবাহে
তোমাদের কোন গোনাহ নেই। তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রী এবং দুই বোনকে একত্রে
বিবাহ করা; কিন্তু যা অতীত হয়ে
গেছে। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাকরী, দয়ালু।’ -সূরাহ নিসা(সূরাহ-৪) আয়াত-২৩
'আর সকল বিবাহিত নারীও তোমাদের জন্যে(বিয়ে করা)নিষিদ্ধ;
তবে তোমাদের ডান হাতের অধিকারভুক্তরা(যুদ্ধবন্দী নারী ও দাস) ছাড়া। তোমাদের জন্য এটি আল্লাহর নির্দেশ। তাদেরকে ছাড়া তোমাদের জন্যে অন্য সকল নারী বৈধ করা হয়েছে,শর্ত এই যে, তোমরা তাদেরকে যৌতুকের বিনিময়ে পেতে চাইবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করার জন্য,ব্যভিচারের জন্য নয়। অতএব তাদের কাছ থেকে তোমরা যা লাভ করতে (বিবাহিত সম্পর্কের মাধ্যমে) চাও, সে জন্য তাকে তার প্রাপ্য যৌতুক প্রদান করো, আবশ্যকীয় হিসেবে। এই (আবশ্যকীয়) কর্তব্য পালনের পর তোমরা পরষ্পর সম্মতিক্রমে যা করো তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন,তিনি সর্বজ্ঞানী।' -সূরাহ নিসা(সূরাহ-৪) আয়াত-২৪
'তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত, তাদের বিবাহ দিয়ে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছ্বল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।'-সূরাহ নূর,২৪ঃ৩২
'.. যখন তোমরা তাদেরকে মোহরানা প্রদান কর তাদেরকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণের জন্যে, কামবাসনা চরিতার্থ করার জন্যে কিংবা গুপ্ত প্রেমে লিপ্ত হওয়ার জন্যে নয়। আর যে ব্যক্তি বিশ্বাসের জায়গায় অবিশ্বাস আনলো, তার কর্ম বিফল হয়ে গেল এবং পরকালে সে ক্ষতিগ্রস্ত হলো।'-সুরাহ আল মাইদাহ(অধ্যায়-৫),আয়াত-৫
‘...তোমাদের দাসীরা সতীত্ব রক্ষা করতে চাইলে পার্থিব জীবনের সম্পদের লোভ-লালসায় তাদেরকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করো না। যদি কেউ তাদের উপর জোর-জবরদস্তি করে, তবে তাদের উপর জোর-জবরদস্তির পর আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন,দয়া করবেন।’
-সূরাহ নূর(অধ্যায়-২৪),আয়াত-৩৩
‘সদকা(দাতব্য)শুধু তাদের হক যারা গরীব, নিঃস্ব, যারা সংশ্লিষ্ট কর্মচারী,যাদের মন জয়ের প্রয়োজন, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের ঋণমুক্তির জন্য, আল্লাহর পথে সংগ্রামরতদের ও মুসাফিরদের জন্য; এটাই আল্লাহর বিধান; আল্লাহ সর্বজ্ঞ, জ্ঞানী।’
-সুরাহ তওবা, আয়াত-৬০
(৫) ৪-নং অনুচ্ছেদে উল্লেখিত কয়েকটি আয়াত থেকে অনুধাবন করা যায় যে বিশ্বাসীদের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ হলো, দাসদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী তাদেরকে বিয়ে দেয়া কর্তব্য। ডান হাতের অধিকারভুক্ত নারী যুদ্ধবন্দী বা দাসীদেরকে যৌন দাসী হিসেবে যৌন নিপীড়ন করা যাবে না, বা ব্যভিচারে বা পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা যাবে না। কাজেই মারিয়া কিবতিয়া ইসলাম গ্রহণের ফলে বিশ্বাসী নারী হিসেবে নবীর স্ত্রী হিসেবে গৃহীত হবেন এটিই স্বাভাবিক বিবেচনা। নবীর পক্ষে মারিয়া কিবতিয়াকে একান্ত যৌন লিপ্সা চরিতার্থ করার জন্য যৌন দাসী হিসেবে গ্রহণ করা অসম্ভব। এর বিরুদ্ধে হাদিসের রেফারেন্সও নেই, বরং যা আছে এর সমর্থনেই আছে ।
(৬) কোথায় বোঝার ভুল? ‘এরপর আপনার জন্য কোনো নারী বৈধ নয়’ (সূরাহ ৩৩ঃ৫২)-এর অর্থ বুঝতে সমালোচকরা ভুল করেছেন । তারা ৩৩ঃ৫০ এর সাথে ৩৩ঃ৫২ আয়াতটিকে মিলিয়ে না পড়ে বিচ্ছিন্ন অর্থ করেছেন যে, এই আয়াত নাযিলের পর থকে আর কোনো নারীকে বিয়ে করা নবীর জন্য বৈধ হবে না।
‘মিন বা’দু’ কথাটির অর্থ করা হয়েছে ভুল ভাবে, যা একটি ক্যাটাগরিকাল মিসটেক।
৩৩ঃ৫০ এর সাথে ৩৩ঃ৫২ মিলিয়ে পড়ুন,
‘হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীদেরকে বৈধ করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেছেন। আর দাসীদেরকে, যাদেরকে আল্লাহ যুদ্ধবন্দী হিসেবে আপনার করায়াত্ব করে দেন, আর আপনার চাচাতো বোন, ফুফাতো বোন, মামাতো বোন, খালাতো বোনকে যারা আপনার সাথে হিজরত করেছে, আর কোনো বিশ্বাসী নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে নিবেদন করে, নবী তাকে বিয়ে করতে চাইলে সেও বৈধ। এটি বিশেষ করে আপনারই জন্য-অন্য বিশ্বাসীদের জন্য নয়। আপনার অসুবিধা দূর করার জন্য। বিশ্বাসীদের স্ত্রী ও দাসীদের ব্যাপারে যা নির্ধারণ করেছি আমার জানা আছে। আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু।’-সূরাহ ৩৩ঃ৫০
এখন সঠিক অর্থ হবে, ৩৩ঃ৫-তে উল্লেখিত নারীদের ছাড়া অন্য কোনো নারীদেরকে বিয়ে করা আর বৈধ হবে না। এই অর্থের বাইরে অন্য অর্থ খুঁজতে গেলেই ক্যাটাগরি মিসটেক হবে এবং তখন একটি অদ্ভুত সংশোধনী আনতে হবে যে, পরের আয়াতটি দ্বারা পূর্বের আয়াতটি বাতিল বলে গণ্য হয়েছিলো!
একইভাবে ৪:২৪ আয়াতটির অর্থ বুঝতে হবে ৪ঃ২৩ আয়াতের অনুসংগ
হিসেবে। আবু দাউদের হাদিস(২১৫৫)।
Comments
Post a Comment